উগারিত বাল দেবতার ছায়ায় প্রাচীন শহর

উগারিত বাল দেবতার ছায়ায় প্রাচীন শহর

উগারিত বাল দেবতার ছায়ায় প্রাচীন শহর

 উনিশশো আঠাশ সালে, সিরিয়ার একজন কৃষকের লাঙ্গল একটা পাথরে গিয়ে ধাক্কা খায়, যেটার তলায় একটা কবর ছিল আর এর মধ্যে প্রাচীন চিনামাটির বাসনপত্র ছিল। তার এই আবিষ্কারের তাৎপর্য তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। এই অপ্রত্যাশিত আবিষ্কারের কথা শুনে, পরের বছর ক্লোড শেফ্যারের পরিচালনায় এক ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক দল সেখানে যাত্রা করে।

অল্পদিন পরেই, মাটি খুঁড়ে একটা খোদিত ফলক পাওয়া যায়, যেটা দলটিকে কন্যি দিয়ে মাটি খোঁড়ার সময় বেরিয়ে আসা সেই ধ্বংসাবশেষকে শনাক্ত করতে সাহায্য করে। এটা ছিল উগারিত, “নিকট প্রাচ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন শহরগুলোর একটা।” এমনকি লেখক ব্যারি হোবারম্যান বলেছিলেন: “কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার, এমনকি ডেড সি স্ক্রোলও বাইবেল সম্বন্ধে আমাদের বোধগম্যতার ওপর এত গভীর প্রভাব ফেলেনি।”—দি আটলান্টিক মান্থলি।

যেখান দিয়ে বড় রাস্তাগুলো চলে গিয়েছিল

ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে, বর্তমানে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে, রাস শামরা নামে পরিচিত একটা টিলায় অবস্থিত, উগারিত সা.কা.পূ. দ্বিতীয় সহস্রাব্দের এক সার্বভৌম শহর ছিল। এর এলাকাটি উত্তরে ক্যাসিয়াস থেকে দক্ষিণে তেল সুকাস পর্যন্ত প্রায় ৬০ কিলোমিটার জুড়ে এবং পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর থেকে পূর্বে অরোন্টেস উপত্যকা পর্যন্ত ৩০ থেকে ৪৫ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত ছিল।

উগারিতের নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতে পশুপাল বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই অঞ্চলে খাদ্যশস্য, জলপাই তেল, দ্রাক্ষারস এবং কাঠ উৎপন্ন হতো—যে-উৎপাদিত দ্রব্যগুলো মেসোপটেমিয়া ও মিশরে খুবই কম উৎপন্ন হতো। এ ছাড়া, বিশেষ বাণিজ্য পথের কেন্দ্রস্থলে এই শহরের অবস্থান এটাকে সর্বপ্রথম প্রধান আন্তর্জাতিক বন্দরগুলোর একটা করে তুলেছিল। উগারিতে, ঈজিয়ান, অ্যানাটোলিয়া, বাবিলন, মিশর এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য জায়গা থেকে ব্যবসায়ীরা ধাতবদ্রব্য, কৃষিজাত দ্রব্য এবং প্রচুর পরিমাণে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিভিন্ন জিনিসের ব্যাবসা করত।

বস্তুগত সমৃদ্ধি সত্ত্বেও, উগারিত সবসময় এক অধীনস্থ রাজ্য ছিল। সা.কা.পূ. চতুর্দশ শতাব্দীতে হিত্তিয় সাম্রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত শহরটি মিশর সাম্রাজ্যের একেবারে উত্তর প্রান্তের প্রধান শহর ছিল। উগারিত কর দিতে এবং এর শাসক শ্রেণীকে সৈন্য সরবরাহ করতে বাধ্য ছিল। যখন আক্রমণকারী “সমুদ্রবাসীরা” * অ্যানাটোলিয়া (মধ্য তুর্কি) এবং সিরিয়ার উত্তরাঞ্চল আক্রমণ করা শুরু করে, তখন হিত্তিয়রা উগারিতের সৈন্যবাহিনী ও নৌবাহিনীকে দখল করে। এর ফলে, উগারিত অরক্ষিত হয়ে পড়ে এবং সা.কা.পূ. প্রায় ১২০০ সালে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।

অতীতকে পুনরুদ্ধার করা

উগারিতের ধ্বংস প্রায় ২০ মিটার উঁচু এবং ৬০ একরেরও বেশি জায়গা জুড়ে এক বিরাট পাথরের ঢিবি রেখে গেছে। এই অঞ্চলের মাত্র এক-ষষ্ঠাংশ খনন করা হয়েছে। ধ্বংসাবশেষের মধ্যে, প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রায় একশোটা ঘর এবং প্রাঙ্গন সহ প্রায় ১০,০০০ বর্গ মিটার জুড়ে পরিত্যক্ত এক বিশাল প্রাসাদ আবিষ্কার করেছে। প্রাসাদটিতে জল সরবরাহ, স্নানাগার এবং পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ছিল। আসবাবপত্র সোনা, নীলকান্তমণি এবং হাতির দাঁত দিয়ে খচিত ছিল। অতি সূক্ষ্মভাবে খোদাই করা হাতির দাঁতের টুকরোগুলো পাওয়া গেছে। প্রাচীরবেষ্টিত এক বাগান এবং গভীর জলের চৌবাচ্চা এই প্রাসাদের আকর্ষণকে বাড়িয়ে তুলেছিল।

এই শহর এবং এর আশপাশের সমভূমি বাল দেবতা ও দাগানের মন্দিরগুলোর কারণে বিশিষ্ট ছিল। * সম্ভবত ২০ মিটার লম্বা এই মন্দির দুর্গগুলোতে, একটা ছোট প্রবেশকক্ষ ছিল যেটা দিয়ে ভিতরের কক্ষে যাওয়া যেত, যেখানে দেবতার একটা মূর্তি রাখা হয়েছিল। একটা সিঁড়ি ছাদের দিকে চলে গেছে, যেখানে রাজা বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। রাতে অথবা ঝড়ঝঞ্ঝার সময়, মন্দিরগুলোর চূড়ায় হয়তো আলোকসংকেত জ্বালানো থাকত, যাতে সেই আলো দেখে জাহাজগুলো নিরাপদে পোতাশ্রয়ে যেতে পারে। যে-নাবিকেরা তাদের নিরাপদে ফিরে আসার কৃতিত্ব ঝড়ের দেবতা বাল-হাদাদকে দিয়েছিল, কোনো সন্দেহ নেই যে তারা সেই দেবতার মন্দিরে পাওয়া ১৭টা পাথরের নোঙ্গর, মানতপূর্বক উৎসর্গ করেছিল।

মূল্যবান খোদিত ফলকগুলোর আবিষ্কার

উগারিতের ধ্বংসাবশেষ জুড়ে হাজার হাজার মাটির ফলক আবিষ্কৃত হয়েছে। অর্থনৈতিক, আইন-সংক্রান্ত, কূটনীতিক এবং প্রশাসনিক পাঠ্যাংশগুলো আটটি ভাষায় পাওয়া গেছে, যেগুলো পাঁচটা মুদ্রাক্ষরে লেখা। শেফ্যারের দল খোদিত কিছু ফলক খুঁজে পেয়েছে, যা এ পর্যন্ত অপরিচিত এমন এক ভাষায় লেখা—যেটাকে উগারিতিক নাম দেওয়া হয়েছে—যেটাতে ৩০টি কীলকাকার চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে আর তা যেকোনো সময়ে আবিষ্কৃত সবচেয়ে পুরনো বর্ণমালাগুলোর মধ্যে একটা গঠন করেছে।

সাধারণ বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা ছাড়াও, উগারিতিক দলিলগুলোতে সাহিত্যিক পাঠ্যাংশও রয়েছে, যা এই সময়ের ধর্মীয় মতবাদ ও অভ্যাসগুলো সম্বন্ধে এক নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে। উগারিতের ধর্মের সঙ্গে প্রতিবেশী কনানীয়দের অভ্যাসের প্রচুর মিল রয়েছে। রলাং ডি ভোর মতানুসারে, এই পাঠ্যাংশগুলো “ইস্রায়েলীয় জয়ের ঠিক আগে কনান দেশের সভ্যতার একেবারে এক সঠিক প্রতিফলন।”

বাল দেবতার শহরের ধর্ম

রাস শামরা পাঠ্যাংশগুলোতে ২০০-রও বেশি দেব-দেবীর বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। সর্বপ্রধান দেবতা ছিল এল, যাকে দেবতাদের ও মানুষের পিতা বলা হতো। আর ঝড়ের দেবতা বাল-হাদাদ ছিল “মেঘের চালক” এবং “পৃথিবীর প্রভু।” এলকে জ্ঞানী, সাদা-দাড়ি বিশিষ্ট একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যে মানবজাতি থেকে অনেক দূরে। অন্যদিকে, বাল হল এক শক্তিমান ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী দেবতা, যে দেবতাদের ও মানবজাতির ওপর শাসন করার চেষ্টা করে।

আবিষ্কৃত পাঠ্যাংশগুলো সম্ভবত ধর্মীয় উৎসবগুলোর সময়, যেমন নতুন বছর অথবা শস্যচ্ছেদনর সময় জোরে জোরে পড়া হতো। কিন্তু, সঠিক ব্যাখ্যা অস্পষ্ট রয়ে গেছে। শাসনব্যবস্থা নিয়ে এক বির্তক বিষয়ক একটা কবিতায় বাল দেবতা, এলের প্রিয় পুত্র, সমুদ্র-দেব ইয়ামকে পরাজিত করে। এই জয় উগারিতের নাবিকদের হয়তো এই নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে, বাল দেবতা তাদেরকে সমুদ্রে রক্ষা করবে। মটের সঙ্গে এক সংঘর্ষে, বাল দেবতা পরাজিত হয় এবং পাতালে চলে যায়। এর ফলে খরা শুরু হয় এবং মানুষের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। বালের স্ত্রী ও বোন আনাট—প্রেম ও যুদ্ধের দেবী—মটকে হত্যা করে এবং আবার বাল দেবতাকে জীবিত করে। বাল কোনো বাছবিচার না করে এলের স্ত্রী আথিরাতের (আশেরা) সন্তানদের হত্যা করে এবং পুনরায় সিংহাসন দখল করে। কিন্তু সাত বছর পর মট আবার ফিরে আসে।

কেউ কেউ এই কবিতাটিকে ঋতুগুলোর বার্ষিক চক্রের এক প্রতীক হিসেবে ব্যাখ্যা করে, যে-সময়ে জীবনদায়ী বর্ষা গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড গরমকে কাটিয়ে শরৎকে ফিরিয়ে আনে। অন্যেরা মনে করে যে, সাত বছরের চক্র দুর্ভিক্ষ ও খরার ভয়কে বর্ণনা করে। যাইহোক না কেন, বালের শ্রেষ্ঠত্বকে মানুষের প্রচেষ্টাগুলোর সফলতার জন্য অত্যাবশ্যক বলে মনে করা হতো। পণ্ডিত পিটার ক্রেগে বলেন: “বালের ধর্মের লক্ষ্য ছিল তার শ্রেষ্ঠত্বকে সুরক্ষিত করা; তাই তার উপাসকরা বিশ্বাস করত যে, একমাত্র তিনি যখন শ্রেষ্ঠ থাকেন, তখনই ফসল ও গবাদি পশুর উৎপাদন শ্রেষ্ঠ থাকবে, যা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অতীব প্রয়োজনীয়।”

পৌত্তলিক ধর্মের বিরুদ্ধে এক আত্মরক্ষামূলক প্রাচীর

মাটি খুঁড়ে আবিষ্কৃত পাঠ্যাংশগুলোতে উগারিতিক ধর্মের কলুষতা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। দি ইলাসট্রেটেড বাইবেল ডিকশনারি মন্তব্য করে: “পাঠ্যাংশগুলো এই দেবতাদের উপাসনার বিকৃত পরিণামগুলো দেখায়; যুদ্ধের ওপর জোর দেওয়ার সঙ্গে, মন্দিরে বেশ্যাবৃত্তি, কামলালসাপূর্ণ প্রেম এবং পরিণামস্বরূপ সামাজিক অধঃপতন।” ডি ভো বলেন: “এই কবিতাগুলো পড়ে, ইয়াওয়ের সত্য বিশ্বাসীরা এবং মহান ভাববাদীরা এই উপাসনার প্রতি যে-ঘৃণা বোধ করেছিল, একজন ব্যক্তি তা বুঝতে পারে।” প্রাচীন ইস্রায়েল জাতিকে ঈশ্বর যে-ব্যবস্থা দিয়েছিলেন, তা এই ধরনের মিথ্যা ধর্মের বিরুদ্ধে এক আত্মরক্ষামূলক প্রাচীর ছিল।

উগারিতের সব জায়গায় ভবিষ্যৎ কথন, জ্যোতিষবিদ্যা এবং জাদুবিদ্যা অভ্যাস করা হতো। চিহ্ন ও অশুভ লক্ষণগুলো কেবল আকাশেই অন্বেষণ করা হতো না কিন্তু নিহত জীবজন্তুর ভ্রূণ ও নাড়িভুঁড়ির মধ্যেও অন্বেষণ করা হতো। ইতিহাসবেত্তা ঝাকলিন গেশ্যা বলেন, ‘বিশ্বাস করা হতো যে, আচার-অনুষ্ঠান করে যে-দেবতাকে বলিকৃত পশু উৎসর্গ করা হতো, সেটা সেই দেবতার একটা অংশ হয়ে উঠত আর তাই দেবতার আত্মা পশুর আত্মার সঙ্গে বিলীন হয়ে যেত। এর ফলে, এই অঙ্গপ্রতঙ্গের ওপর দৃশ্যত চিহ্নগুলো পড়ে দেবতাদের মনোভাব স্পষ্টভাবে জানা সম্ভবপর হতো, যারা ভবিষ্যতের ঘটনাগুলো সম্বন্ধে কোনো প্রশ্নের অথবা নির্দিষ্ট একটা পরিস্থিতিতে কী করা দরকার, সেই বিষয়ে হয় ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক উত্তর দিতে পারত।’ (লি পেজ ডি উগারিত অটুর ডি ১২০০ এভি.জে.সি.) অন্যদিকে, ইস্রায়েলীয়দের এই ধরনের অভ্যাসগুলো এড়িয়ে চলতে হতো।—দ্বিতীয় বিবরণ ১৮:৯-১৪.

মোশির ব্যবস্থায় পশুর সঙ্গে শয়ন করাকে স্পষ্টভাবে নিষেধ করা হয়েছে। (লেবীয় পুস্তক ১৮:২৩) এই অভ্যাসকে উগারিতে কীভাবে দেখা হতো? আবিষ্কৃত পাঠ্যাংশগুলোতে দেখা যায় যে, বাল দেবতা একটা বকনা-বাছুরের সঙ্গে যৌনসঙ্গমে রত। প্রত্নতাত্ত্বিক সাইরাস গরডন বলেছিলেন, “যদি এভাবেও যুক্তি করা হয় যে, এই কাজ করার জন্য বাল দেবতা একটা ষাঁড়ের রূপ ধরেছিল, তবুও তার যাজকদের সম্বন্ধে সেই একই বিষয় বলা যেতে পারে না, যারা তার পৌরাণিক কাজকে অভিনয় করে দেখিয়েছিল।”

ইস্রায়েলীয়দের আদেশ দেওয়া হয়েছিল: “মৃত লোকের জন্য আপন আপন অঙ্গে অস্ত্রাঘাত করিও না।” (লেবীয় পুস্তক ১৯:২৮) কিন্তু বাল দেবতার মৃত্যুর প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে এল “একটা ছুরি দিয়ে তার চামড়া কেটেছিল, খুর দিয়ে কাটাছেঁড়া করেছিল; সে তার গাল ও থুতনি কেটেছিল।” আচার-অনুষ্ঠান সংক্রান্ত ক্ষত স্পষ্টতই বাল উপাসকদের মধ্যে একটা প্রথা ছিল।—১ রাজাবলি ১৮:২৮.

একটা উগারিতিক কবিতা এমন ইঙ্গিত করে বলে মনে হয় যে, দুধের মধ্যে একটা ছাগলছানাকে রান্না করা সাধারণত কনানীয় ধর্মে উর্বরতার আচার-অনুষ্ঠানের অংশ ছিল। কিন্তু মোশির ব্যবস্থায়, ইস্রায়েলীয়দের আদেশ দেওয়া হয়েছিল: “ছাগবৎসকে তাহার মাতার দুগ্ধে পাক করিও না।”—যাত্রাপুস্তক ২৩:১৯.

বাইবেল পাঠ্যাংশগুলোর সঙ্গে তুলনা

মূলত উগারিতিক পাঠ্যাংশগুলো প্রথমে বাইবেলের ইব্রীয় শাস্ত্রের সাহায্যে অনুবাদ করা হয়েছিল। পিটার ক্রেগে বলেন: “ইব্রীয় পাঠ্যাংশে এমন অনেক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যেগুলোর অর্থ স্পষ্ট নয় আর কখনও কখনও অপরিচিত; বিংশ শতাব্দীর আগের অনুবাদকরা বিভিন্ন মাধ্যম দ্বারা সেগুলোর সম্ভাব্য অর্থ অনুমান করেছে। কিন্তু উগারিতিক পাঠ্যাংশে যখন সেই একই শব্দগুলো দেখা যায়, তখন এর অর্থ বোঝা সম্ভবপর হয়।”

উদাহরণ হিসেবে, যিশাইয় ৩:১৮ পদে ব্যবহৃত একটা ইব্রীয় শব্দকে সাধারণভাবে “জালিবস্ত্র” অনুবাদ করা হয়েছে। এক অনুরূপ উগারিতিক উৎস সূর্য ও সূর্য-দেবী উভয়কেই আখ্যা দেয়। তাই, যিশাইয়ের ভবিষ্যদ্বাণীতে উল্লেখিত স্ত্রীলোকেরা কনানীয় দেবতাদের সম্মানার্থে হয়তো গলার হারে সূর্যের ছোট্ট লকেট আর সেইসঙ্গে “চন্দ্রহার” পরত।

ম্যাসোরেটিক পাঠ্যাংশে হিতোপদেশ ২৬:২৩ পদে “জ্বলন্ত ওষ্ঠ এবং দুষ্ট হৃদয়”-কে একটা মাটির পাত্রের সঙ্গে তুলনা করা হয়, যা “রুপোর গাদ” দিয়ে ঢাকা। উগারিতিক ভাষার মূল এই তুলনাকে “মাটির পাত্রের এক ভাঙা টুকরোর ওপর চমকের মতো,” এভাবে অনুবাদ করার সুযোগ দেয়। নতুন জগৎ অনুবাদ (ইংরেজি) যথার্থভাবে এই প্রবাদকে অনুবাদ করে: “মাটির পাত্রের একটি টুকরোর ওপর যেমন রুপোর চকচকে প্রলেপ, তেমনি মন্দ হৃদয় সহ ঐকান্তিক ওষ্ঠ।”

বাইবেল সংক্রান্ত ভিত্তি?

রাস শামরার পাঠ্যাংশগুলোকে পরীক্ষা করে দেখা কিছু পণ্ডিতকে এই দাবি করতে পরিচালিত করেছে যে, বাইবেলের নির্দিষ্ট কিছু অংশ উগারিতিক কাব্যিক সাহিত্য থেকে নেওয়া হয়েছে। ফরাসি প্রতিষ্ঠানের সদস্য আন্দ্রে ক্যাকো বলেন যে, “ইস্রায়েলীয়দের ধর্মের ভিত্তিই হল কনানীয়দের সংস্কৃতি।”

গীতসংহিতা ২৯ সম্বন্ধে রোমের পন্টিফিক্যাল বিবলিক্যাল ইন্সটিটিউটের মিচেল ডাহুড বলেন: “এই গীতটি ইয়েওয়ের উপাসকেরা ঝড়ের দেবতা বালের উদ্দেশে এক প্রাচীন কনানীয় স্তোত্র থেকে নিয়েছে . . . তাই বলতে গেলে এই গীতের প্রায় প্রতিটি শব্দকে এখন প্রাচীন কনানীয় পাঠ্যাংশের প্রতিলিপি বানানো যেতে পারে।” এই ধরনের উপসংহার কি সঠিক? বস্তুতপক্ষে না!

অধিক যুক্তিবাদী পণ্ডিতরা স্বীকার করে যে, সাদৃশ্যগুলোর কথা বাড়িয়ে বলা হয়েছে। ঈশ্বরতত্ত্ববিদ গ্যারি ব্রান্টলি বলেন, ‘একটিও উগারিতিক পাঠ্যাংশের ২৯ গীতের পুরোটার সঙ্গে মিল নেই। ২৯ গীত (অথবা বাইবেলের অন্য যেকোনো বই) পৌত্তলিক পৌরাণিক কাহিনী থেকে নেওয়া হয়েছে, এই মন্তব্যের কোনো প্রামাণিক ভিত্তি নেই।’

বাক্যের গঠন, কাব্যিক সাদৃশ্য এবং রচনাশৈলী সংক্রান্ত দিকগুলোতে যে-মিলগুলো রয়েছে, সেটা কি প্রমাণ করে যে তা উগারিতিক পাঠ্যাংশ থেকে নেওয়া? অন্যদিকে, এই ধরনের সাদৃশ্যগুলো আশা করা যায়। দি এনসাইক্লোপিডিয়া অফ রিলিজিয়ন বলে: “গঠন ও বিষয়বস্তুর এই সাদৃশ্যের কারণটি হল সাংস্কৃতিক: উগারিত ও ইস্রায়েলের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ ভৌগলিক ও অনাধ্যাত্মিক বিষয়ে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, সেগুলো বৃহত্তর সাংস্কৃতিক সত্তার একটা অংশ ছিল, যা এক সাধারণ কাব্যিক ও ধর্মীয় শব্দভাণ্ডারকে ভাগ করে নিয়েছিল।” তাই গ্যারি ব্রান্টলি উপসংহারে বলেন: “শুধুমাত্র ভাষাগত সাদৃশ্যগুলোর জন্য জোর করে পৌত্তলিক বিশ্বাসগুলোকে বাইবেল পাঠ্যাংশের উৎস বলে ব্যাখ্যা করা সঠিক নয়।”

শেষে, এটা লক্ষ করা উচিত যে, যদি রাস শামরা পাঠ্যাংশগুলো ও বাইবেলের মধ্যে কোনো সাদৃশ্য থেকেও থাকে, তবুও সেগুলো পুরোপুরি সাহিত্যিক, আধ্যাত্মিক নয়। প্রত্নতাত্ত্বিক সাইরাস গরডন বলেন, “বাইবেলে যে-নীতি ও নৈতিক উৎকর্ষগুলো পাওয়া যায় তা উগারিতে পাওয়া যায় [না]।” বস্তুত, সাদৃশ্যগুলোর চেয়ে পার্থক্যগুলো আরও অনেক বেশি।

উগারিতিক গবেষণা সম্ভবত বাইবেল ছাত্রদেরকে বাইবেল লেখক এবং সাধারণ ইব্রীয় জাতির সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় পরিবেশ বুঝতে সাহায্য করে যাবে। এ ছাড়া, রাস শামরার পাঠ্যাংশগুলোর অতিরিক্ত পরীক্ষা হয়তো প্রাচীন ইব্রীয় বোধগম্যতার ওপর নতুন আলো বর্ষণ করবে। কিন্তু সর্বোপরি, উগারিতে প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলো স্পষ্টভাবে বাল দেবতার প্রতি বিকৃত ভক্তি ও যিহোবার শুদ্ধ উপাসনার মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরে।

[পাদটীকাগুলো]

^ সাধারণত ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ ও সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো থেকে আসা সমুদ্রগামী নাবিকদেরকে ‘সমুদ্রবাসী’ হিসেবে শনাক্ত করা হয়। পলেষ্টীয়রা হয়তো তাদের মধ্যে ছিল।—আমোষ ৯:৭.

^ যদিও মতভেদ রয়েছে, তবুও কেউ কেউ দাগানের মন্দিরকে এলের মন্দির বলে শনাক্ত করে। ফরাসি পণ্ডিত এবং যিরূশালেম স্কুল অফ বিবলিক্যাল স্টাডিস এর অধ্যাপক রলাং ডি ভো বলেন যে, দাগান—বিচারকর্ত্তৃগণের বিবরণ ১৬:২৩ এবং ১ শমূয়েল ৫:১-৫ পদের দাগোন—হল এলের সঠিক নাম। দি এনসাইক্লোপিডিয়া অফ রিলিজিয়ন বলে যে, সম্ভবত “দাগান যেকোনোভাবেই হোক [এলের] সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অথবা অন্তর্ভুক্ত।” রাস শামরার পাঠ্যাংশগুলোতে, বাল দেবতাকে দাগানের পুত্র বলা হয়েছে কিন্তু ‘পুত্রের’ অর্থ এখানে স্পষ্ট নয়।

[২৫ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]

উগারিতে প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলো শাস্ত্র সম্বন্ধে আমাদের বোধগম্যতাকে বাড়িয়েছে

[২৪, ২৫ পৃষ্ঠার মানচিত্র/চিত্রগুলো]

সাধারণ কাল পূর্ব চতুর্দশ শতাব্দীতে হিত্তিয় সাম্রাজ্য

ভূমধ্য সাগর

অরোনটেস

ক্যাসিয়াস পর্বত (জিবেল এল-আগ্রা)

উগারিত (রাস শামরা)

তেল সুকাস

অরোনটেস

সিরিয়া

মিশর

ইউফ্রে

ট্রিস

[সৌজন্যে]

একটা পশুর মাথার আকারে বাল দেবতার প্রতিমূর্তি ও প্রাচীনকালের পানপাত্র: Musée du Louvre, Paris; রাজ প্রাসাদের চিত্রাঙ্কন: © D. Héron-Hugé pour “Le Monde de la Bible”

[২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

প্রাসাদের প্রবেশকক্ষের ধ্বংসাবশেষ

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

এক পৌরাণিক উগারিতিক কবিতা হয়তো যাত্রাপুস্তক ২৩:১৯ পদে বাইবেলের একটা নিষিদ্ধ বিষয়ের পটভূমি জোগায়

[সৌজন্যে]

Musée du Louvre, Paris

[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]

বালের ফলক

সোনার পাত্র শিকারের একটা দৃশ্য তুলে ধরে

হাতির দাঁতের তৈরি প্রসাধনী বাক্সের ঢাকনা, যেটা এক উর্বরতার দেবীকে চিত্রিত করে

[সৌজন্যে]

সমস্ত ছবি: Musée du Louvre, Paris