জীবনকাহিনি
যুদ্ধ ও শান্তির সময়কালে যিহোবার কাছ থেকে আমরা সাহস পেয়েছি
পল: সময়টা ছিল ১৯৮৫ সালের নভেম্বর মাস। আমরা প্রথম বার মিশনারি যাত্রার জন্য পশ্চিম আফ্রিকার লাইবেরিয়াতে যাচ্ছিলাম। আমি এবং আমার স্ত্রী অ্যান অনেক আনন্দিত ছিলাম। যাওয়ার সময় আমাদের প্লেন সেনেগালে দাঁড়িয়েছিল। অ্যান বলে, “মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে আমরা লাইবেরিয়া পৌঁছে যাব!” তখনই একটা ঘোষণা হয়, “লাইবেরিয়াতে যাওয়ার সমস্ত যাত্রী প্লেন থেকে নেমে পড়ুন। আমরা সেখানে যাব না। সেখানকার বিরোধী দল সরকারের পতন আনতে চায় এবং পরিস্থিতি খুব খারাপ।” আগামী দশ দিন আমরা সেনেগালে মিশনারি ভাই-বোনদের কাছে থেকে যাই। আমরা খবরে শুনছিলাম যে, লাইবেরিয়াতে অনেক যুদ্ধ ও অশান্তি চলছে, ট্রাক ভরতি করে করে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং কারফিউ জারি করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, কেউ যদি কারফিউ না মানে, তা হলে তাকে গুলি করা হবে।
অ্যান: কিছু লোক অনেক সাহসী হয়। তারা এমনকী জীবনের ঝুঁকিও নেয়। কিন্তু, আমরা সেই লোকদের মতো নই। আমি ছোটো থেকেই একটু ভীতু স্বভাবের ছিলাম। আমি ছোটোবেলায় রাস্তা পার হতে পারতাম না। লোকেরা আমাকে “ভীতু অ্যানি” বলে ডাকত। কিন্তু, আমি এবং আমার স্বামী স্থির করেছিলাম যে, আমরা লাইবেরিয়াতে অবশ্যই যাব।
পল: আমার ও অ্যানের জন্ম ইংল্যাণ্ডে। আমার বাড়ি অ্যানের বাড়ি থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে ছিল। তার মা এবং আমার বাবা-মা সবসময় বলতেন, আমরা যেন অগ্রগামী সেবা করি। তাই, স্কুল শেষ করার পরেই আমরা পূর্ণসময়ের সেবা করার সিদ্ধান্ত নিই আর আমরা অগ্রগামী সেবা করতে শুরু করি। এই কারণে তারা অনেক খুশি ছিলেন। আমার বয়স যখন ১৯ বছর হয়, তখন আমাকে বেথেলে সেবা করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এরপর ১৯৮২ সালে আমাদের বিয়ের পরে অ্যানও বেথেলে সেবা করতে শুরু করে।
১৯৮৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর গিলিয়েড গ্র্যাজুয়েশনের দিন
অ্যান: আমাদের বেথেলে সেবা করতে ভালো লাগত, কিন্তু আমরা সবসময় এমন জায়গায় গিয়ে সেবা করতে চেয়েছিলাম, যেখানে বেশি প্রয়োজন রয়েছে। বেথেলে এমন অনেক ভাই-বোন ছিল, যারা আগে মিশনারি ছিল, তাদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে আমাদের মধ্যে মিশনারি সেবা করার ইচ্ছা আরও বেড়ে গিয়েছিল। আমরা তিন বছর ধরে প্রতিদিন এই বিষয়ে প্রার্থনা করে চলি। আর ১৯৮৫ সালে আমরা আমাদের প্রার্থনার উত্তর পাই। আমাদের গিলিয়েডের ৭৯-তম ক্লাসে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমরা অনেক খুশি ছিলাম! স্কুল শেষ হওয়ার পর আমাদের পশ্চিম আফ্রিকার লাইবেরিয়াতে পাঠানো হয়।
ভাই-বোনদের প্রেম আমাদের অনেক সাহস জুগিয়েছিল
পল: লাইবেরিয়ার পরিস্থিতি যখন একটু ঠিক হয়েছিল, তখন আবারও সেখানে প্লেন যেতে শুরু করেছিল। আর আমরা প্রথম প্লেন ধরেই সেখানে যাই। কিন্তু, এখনও সেখানে কারফিউ চলছিল এবং লোকেরা অনেক আতঙ্কিত ছিল। গাড়ির সাইলেন্সারের আওয়াজ শুনেও লোকেরা ভয় পেয়ে যেত এবং এদিক-ওদিক পালাতে শুরু করত। প্রতিদিন রাতে আমরা গীতসংহিতা বই থেকে কিছু পদ পড়তাম, যাতে আমরা শান্ত থাকতে পারি। সেখানে থাকা সহজ ছিল না, কিন্তু আমরা আমাদের কার্যভারকে অনেক ভালোবাসতাম। a অনেক অভিজ্ঞতা ছিল এবং তিনি ভাই-বোনদের পরিস্থিতি খুব ভালোভাবে বুঝতে পারতেন। তিনি আমাকে খুব ভালো প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।
অ্যান প্রতিদিন প্রচারে যেত আর আমি ভাই জন চেরুকের সঙ্গে বেথেলে কাজ করতাম। ভাই চেরুকেরঅ্যান: জানেন, কেন আমাদের লাইবেরিয়া এত ভালো লেগেছিল? কারণ সেখানকার ভাই-বোনেরা খুবই প্রেমময় ছিল। আমরা বুঝতেই পারিনি যে, তারা কখন আমাদের এত আপন হয়ে গিয়েছিল। আমরা একটা নতুন পরিবার পেয়েছিলাম। ভাই-বোনেরা আমাদের অনেক সাহায্য করেছিল, ভালো পরামর্শ দিয়েছিল এবং উৎসাহিত করেছিল। সেখানে প্রচার করতেও আমাদের খুব ভালো লাগত আর লোকেরাও আমাদের কথা শুনতে চাইত। আমরা যদি তাদের ঘর থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসতে চাইতাম, তা হলে তারা দুঃখ পেত। লোকেরা বাইবেল নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করত। আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়েও তাদের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলতে পারতাম। দু-জন ব্যক্তি যদি একে অপরের সঙ্গে কথা বলে আর আমরা যদি তাদের মাঝখানে গিয়ে কথা বলতে শুরু করি, তা হলে তারা খারাপ মনে করত না। আমাদের কাছে এত বাইবেল অধ্যয়ন ছিল যে, সবাইকে সময় দেওয়া আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যেত। তবে, এই সমস্যা তো খুব ভালোই লাগে!
ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু যিহোবা আমাদের সাহস জুগিয়েছিলেন
১৯৯০ সালে ভাই-বোনেরা যখন পালিয়ে লাইবেরিয়া বেথেলে এসেছিল
পল: চার বছর ধরে যদিও কিছুটা শান্তি ছিল, কিন্তু ১৯৮৯ সালে গৃহ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বিরোধী দলের জঙ্গিরা ১৯৯০ সালের ২ জুলাই বেথেলের আশেপাশের এলাকাগুলো দখল করে নেয়। তিন মাস ধরে আমরা আমাদের পরিবার ও বিশ্বপ্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি। চারিদিকে মারামারি ও দাঙ্গা চলছিল, খাবার পাওয়া যাচ্ছিল না এবং মহিলাদের ধর্ষণ করা হচ্ছিল। ১৪ বছর ধরে দেশের অবস্থা এইরকমই ছিল।
অ্যান: কিছু জাতির লোক অন্য জাতির লোকদের সঙ্গে লড়াই করছিল এবং একে অন্যকে হত্যা করছিল। জঙ্গিরা অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত, অদ্ভুত অদ্ভুত পোশাক পরত এবং লোকদের ঘরে ঢুকে লুটপাট চালাত। তাদের কাছে অন্যদের হত্যা করা মুরগি কাটার মতোই সাধারণ বিষয় ছিল। তারা জায়গায় জায়গায় অবরোধ করে রেখেছিল এবং মৃত দেহের স্তূপ করে রেখেছিল। শাখা অফিসের আশেপাশেও একই অবস্থা ছিল। আমাদের অনেক বিশ্বস্ত ভাই-বোনকে মেরে ফেলা হয়েছিল আর তাদের মধ্যে দু-জন মিশনারিও ছিল।
জঙ্গিরা অন্য জাতির লোকদের খুঁজে খুঁজে মেরে ফেলছিল। এইরকম পরিস্থিতিতে ভাই-বোনেরা নিজেদের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলে অন্য জাতির ভাই-বোনদের তাদের বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিল। মিশনারি ভাই-বোনেরা এবং বেথেলে সেবা করে এমন ভাই-বোনেরাও এটাই করেছিল। কিছু ভাই-বোন পালিয়ে বেথেলে চলে এসেছিল। এর মধ্যে কিছু ভাই-বোন আমাদের উপর তলার ঘরগুলোতে থাকত। আর কিছু নীচের তলার অফিসগুলোতে থাকত। আমরা আমাদের ঘরে ৭ জনের একটা পরিবারকে রেখেছিলাম।
পল: জঙ্গিরা প্রতিদিন এসে দেখার চেষ্টা করত যে, আমরা অন্য জাতির লোকদের লুকিয়ে রেখেছি কি না। পাহারা দেওয়ার জন্য আমরা চার জন ভাইকে নিযুক্ত করেছিলাম। যখন কেউ আসত, তখন দু-জন ভাই দরজার কাছে যেত এবং দু-জন ভাই জানালা দিয়ে তাদের উপর নজর রাখত। যে-ভাইয়েরা দরজার কাছে যেত,
তারা সামনের দিকে হাত জোড় করত, এর মানে ছিল সব কিছু ঠিক আছে। কিন্তু, যদি তারা তাদের হাত পিছনের দিকে রাখত, তা হলে অন্য দু-জন ভাই বুঝে যেত যে, জঙ্গিরা খুবই রেগে রয়েছে আর সেই ভাইয়েরা দ্রুত গিয়ে ভাই-বোনদের লুকিয়ে রাখত।অ্যান: কয়েক সপ্তাহ পর কিছু জঙ্গি জোর করে বেথেলে ঢুকে পড়ে। আমি একজন বোনকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ি এবং দরজা বন্ধ করে দিই। বাথরুমের ভিতরে একটা ছোটো আলমারি ছিল, যার মধ্যে লুকোনোর জন্য একটা ছোটো জায়গা ছিল। আমি যেকোনোভাবে সেই বোনকে সেখানে লুকিয়ে রেখেছিলাম। তারা আমার পিছন পিছন উপরে চলে আসে। তাদের হাতে মেশিন গান (বন্দুক) ছিল। তারা জোরে জোরে বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করে। পল তাদের আটকানোর চেষ্টা করে এবং বলে যে, “আমার স্ত্রী বাথরুম গিয়েছে।” বোনকে সেখানে লুকোনোর পর আমি আলমারিতে জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করি আর এর জন্য কিছু সময় লেগে যায়। আমার মনে হয়েছিল যে, সেই জঙ্গিরা আমাদের আওয়াজ শুনে নিয়েছে এবং তাদের সন্দেহ হয়েছে। তাই, আমি ভয়ে কাঁপতে শুরু করি। এমন পরিস্থিতিতে আমি কীভাবে দরজা খুলতাম? ঠিক সেই সময় আমি মনে মনে প্রার্থনা করি আর যিহোবার কাছে সাহায্য চাই। তারপর আমি দরজা খুলি আর স্বাভাবিকভাবে তাদের সম্বোধন জানাই। তাদের মধ্যে একজন আমাকে ধাক্কা দিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ে আর আলমারি খুলে দেখতে শুরু করে। সে সমস্ত জিনিসপত্র এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে দেয়। সে অনেক বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল কারণ সে কিছুই খুঁজে পায়নি। তারপর সে এবং তার সঙ্গীরা উপর থেকে নীচ পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে, কিন্তু তারা কিছুই খুঁজে পায় না।
অন্ধকারেও সত্যের আলো জ্বলতে থাকে
পল: আমাদের কাছে খাবারদাবার অনেক কম ছিল, কিন্তু আধ্যাত্মিক খাবারের অভাব ছিল না। বেশ কিছু মাস ধরে আমরা সকালের খাবারে শুধুমাত্র সকালের উপাসনা শুনতাম। আমরা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না যে, সেটা থেকে আমরা কতটা শক্তি পেয়েছিলাম!
আমরা বাইরে গিয়ে খাবার নিয়ে আসতে পারতাম না কারণ যে-ভাই-বোনেরা বেথেলে লুকিয়েছিল তাদের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়তে পারত। আমরা দেখেছি, অনেক বার যিহোবা একেবারে সঠিক সময়ে এবং এমন উপায়ে আমাদের সাহায্য করেছিলেন যেটা আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারি না। তিনি সবসময় আমাদের যত্ন নিয়েছেন এবং ভয় কাটিয়ে উঠতে আমাদের সাহায্য করেছেন।
লাইবেরিয়াতে পরিস্থিতি দিনের পর দিন খারাপ হচ্ছিল আর আশার কোনো আলো দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু, সত্যের কারণে ভাই-বোনেরা আশা ছাড়েনি। নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য তাদের অনেক বার পালিয়ে যেতে হয়েছিল, কিন্তু তাদের বিশ্বাস দুর্বল হয়ে পড়েনি। কঠিন পরিস্থিতিতেও তারা শান্ত ছিল। তাদের মধ্যে কিছু জন বলছিল, এই সমস্যাগুলো তাদের মহাক্লেশের জন্য প্রস্তুত করছে। প্রাচীনেরা ও যুবক ভাইয়েরা অনেক সাহস দেখিয়েছিল এবং ভাই-বোনদের সাহায্য করেছিল। আর ভাই-বোনেরাও একে অন্যের যত্ন নিয়েছিল। যখন তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পালিয়ে যেত, তখনও তারা প্রচার করত এবং সভা পরিচালনা করত। তারা জঙ্গলে গাছের ডাল ও পাতা দিয়ে কিংডম হল তৈরি করেছিল। এই কঠিন সময়ে সভা এবং প্রচার কাজ থেকে ভাই-বোনেরা অনেক সাহস পেয়েছিল। যখন আমরা ভাই-বোনদের ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করছিলাম, তখন অনেকে জামাকাপড় চাওয়ার পরিবর্তে প্রচার কাজ করার জন্য ব্যাগ চেয়েছিল। এই বিষয়টা আমাদের হৃদয় স্পর্শ করেছিল! সেখানে লোকেরা অনেক দুঃখিত ছিল এবং ভয়ের মধ্যে ছিল। যখন আমরা তাদের কাছে সুসমাচার জানাতাম, তখন তারা আমাদের কথা মন দিয়ে শুনত। তারা এটা দেখে অবাক হয়ে যেত যে, এত সমস্যা থাকা সত্ত্বেও যিহোবার সাক্ষি হিসেবে আমরা কত খুশি। সত্যিই ভাই-বোনেরা অন্ধকারের মথি ৫:১৪-১৬) তাদের উদ্যোগ দেখে কিছু জঙ্গিও পরবর্তী সময়ে সত্যকে আপন করেছিল।
মধ্যেও আলোর মতো জ্বলজ্বল করছিল! (ভাইদের কাছ থেকে দূরে যেতে যিহোবা সাহস জুগিয়েছিলেন
পল: সময়ে সময়ে আমাদের লাইবেরিয়া ছেড়ে যেতে হয়েছিল। তিন বার কিছু সময়ের জন্য আর দুই বার সারা বছরের জন্য। একজন মিশনারি বোন বলেছিলেন যে, “গিলিয়েডে স্কুলে আমাদের শেখানো হয়েছিল যে, আমাদের যে-কাজই দেওয়া হোক না কেন, আমরা যেন তা মনপ্রাণ দিয়ে করি। আর আমরা এমনটাই করেছিলাম। তাই, কঠিন সময়ে যখন আমাদের ভাই-বোনদের ছেড়ে যেতে হয়েছিল, তখন আমাদের অনেক কষ্ট হয়েছিল। আমরা একেবারে ভেঙে পড়েছিলাম!” আমাদেরও প্রতি বার লাইবেরিয়া ছাড়ার সময় এইরকমই অনুভব হত। কিন্তু খুশির বিষয় যে, লাইবেরিয়া থেকে দূরে থাকা সত্ত্বেও আমরা ভাই-বোনদের সাহায্য করতে পেরেছিলাম।
১৯৯৭ সালে আমরা আনন্দের সঙ্গে লাইবেরিয়াতে ফিরে আসি
অ্যান: সময়টা ছিল ১৯৯৬ সালের মে মাস। আমরা বেথেল থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে একটা সুরক্ষিত জায়গায় যেতে চেয়েছিলাম। তাই, আমরা চার জন বেথেলের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। আমাদের কাছে শাখা অফিসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ছিল। কিন্তু, তখনই আমাদের এলাকায় দাঙ্গা শুরু হয়। জঙ্গিরা হাওয়ায় গুলি ছুড়তে থাকে আর তারা আমাদের গাড়ি থামিয়ে দেয়। তারা আমাদের তিন জনকে গাড়ি থেকে বের করে দেয় এবং আমাদের গাড়ি করে পলকে নিয়ে চলে যায়। হঠাৎ কী হয়ে গেল, আমরা তা বুঝতেই পারিনি। এরপর হঠাৎই পল ভিড়ের মধ্য থেকে আমাদের দিকে আসতে থাকে। তার মাথা থেকে রক্ত পড়ছিল। আমাদের মনে হয়েছিল, তার গুলি লেগেছে। কিন্তু, এরপর আমরা চিন্তা করি, তার যদি গুলি লাগত, তা হলে সে কি হাঁটতে পারত? আসলে, কেউ তাকে মেরে গাড়ি থেকে ফেলে দিয়েছিল। ভালো যে তার বেশি আঘাত লাগেনি!
পাশেই সেনাদের একটা গাড়িতে ঠাসা লোক ছিল। লোকেরা অনেক আতঙ্কিত ছিল। আমরা যাহোক করে সেই গাড়িতে ঝুলে পড়ি। ড্রাইভার এত জোরে গাড়ি চালাচ্ছিল যে, আমরা পড়েই যাচ্ছিলাম। আমরা ড্রাইভারকে থামতে বলি, কিন্তু সে এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে, আমাদের কথাই শোনেনি। তাই, আমরা কোনো প্রকারে গাড়িতে ঝুলতে থাকি। এরপর যখন গাড়ি থামে এবং আমরা নামি, তখন আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। এতক্ষণ ঝুলে থাকার ফলে আমাদের হাত কাঁপতে থাকে।
পল: আমাদের কাছে কিছুই ছিল না। আমাদের জামাকাপড় নোংরা হয়ে গিয়েছিল এবং ছিঁড়ে গিয়েছিল। আমরা একে অন্যের দিকে তাকাই এবং চিন্তা করি, আজ আমরা খুব জোর বেঁচে গিয়েছি! আমরা একটা হেলিকপ্টারের পাশে খোলা জায়গায় শুয়ে পড়ি। সেই হেলিকপ্টারে অনেক গুলির চিহ্ন ছিল আর সেটার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। পরের দিনই আমরা সেই হেলিকপ্টার করে সিয়েরা লিয়োন যাই। আমরা খুশি যে, আমরা বেঁচে আছি, কিন্তু আমরা লাইবেরিয়ার ভাই-বোনদের জন্য অনেক চিন্তা করছিলাম।
যিহোবা আরও একটা কঠিন পরিস্থিতি সহ্য করার জন্য সাহস দিয়েছিলেন
অ্যান: আমরা সুরক্ষিতভাবে সিয়েরা লিয়োন বেথেলে পৌছাই, যেটা ফ্রিটাওন শহরে ছিল। সেখানে ভাইয়েরা খুব ভালোভাবে আমাদের যত্ন নিয়েছিল। কিন্তু, এর পরও যুদ্ধের খারাপ স্মৃতি মনে করে আমি খুব কষ্ট পেতাম। সারাদিন আমি ভয়ে ভয়ে থাকতাম এবং ঠিক মতো চিন্তা করতে পারতাম না। আমি বুঝতে পারতাম না, আমার আশেপাশে যা ঘটছে সেগুলো সত্যি, না কি আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি! আর রাতে হঠাৎ করে আমার ঘুম ভেঙে যেত। আমার মনে হত যে, খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে এবং আমি কাঁপতে শুরু করতাম। আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যেত এবং আমার দম বন্ধ হয়ে আসত। তখন পল আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রার্থনা করত। এ ছাড়া, আমরা রাজ্যের গান গাইতাম আর যতক্ষণ না আমি শান্ত হই, ততক্ষণ আমরা গাইতেই থাকতাম। আমার মনে হয়েছিল, আমি পাগল হয়ে গিয়েছি আর এখন আমি মিশনারি সেবা করতে পারব না।
এরপর এমন কিছু ঘটেছিল, যা আমি কখনো ভুলতে পারব না। সেই সপ্তাহে আমরা দুটো পত্রিকা পেয়েছিলাম। এর মধ্যে একটা ছিল ১৯৯৬ সালের ৮ জুন মাসের সচেতন থাক! (ইংরেজি) পত্রিকা যেটাতে একটা প্রবন্ধ এসেছিল যেটার বিষয় ছিল, “প্যানিক অ্যাটাক আসলে কী করব?” সেটা পড়ে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার আসলে কী হচ্ছে। আর একটা পত্রিকা হল ১৯৯৬ সালের ১৫ মে প্রহরীদুর্গ পত্রিকা সেটাতে একটা প্রবন্ধ এসেছিল যেটার বিষয় ছিল, “তারা কোথা থেকে তাদের শক্তি পায়?” সেই প্রবন্ধে একটা প্রজাপতির ছবি ছিল, যেটার ডানা ভাঙা ছিল। আর সেখানে বলা হয়েছিল যে, ডানা ভেঙে গেলেও প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়। একইভাবে আমরা যখন ভেঙে পড়ি, তখন যিহোবা পবিত্র শক্তির মাধ্যমে আমাদের শক্তি দেন। আর এর ফলে আমরা অন্যদের সাহায্য করতে পারি। এই দুটো প্রবন্ধ ছিল, যিহোবার কাছ থেকে সঠিক সময়ে পাওয়া খাবার। (মথি ২৪:৪৫) আমি এই বিষয়ের উপর আরও প্রবন্ধ খুঁজি এবং সেগুলো একটা ফাইলে রাখি। এগুলো থেকে আমি অনেক সাহায্য পাই। ধীরে ধীরে আমার পরিস্থিতি ঠিক হতে শুরু করে এবং আমার ভয় কেটে যেতে থাকে।
যিহোবা নতুন জায়গায় যাওয়ার জন্য শক্তি দিয়েছিলেন
পল: আমরা যখনই লাইবেরিয়াতে আমাদের বাড়িতে ফিরে আসতাম, তখন খুব খুশি হতাম। ২০০৪ সালের শেষ পর্যন্ত আমরা প্রায় ২০ বছর ধরে সেখানে সেবা করছিলাম। যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল আর শাখা অফিসে কিছু নির্মাণ কাজ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। কিন্তু, এরপর আমাদের বলা হয়েছিল, সেবা করার জন্য আমাদের অন্য জায়গায় পাঠানো হচ্ছে।
এটা আমাদের জন্য অনেক কঠিন ছিল। লাইবেরিয়ার ভাই-বোনেরা আমাদের কাছে পরিবার হয়ে উঠেছিল, তাদের ছাড়া আমরা কীভাবে থাকব! গিলিয়েড যাওয়ার জন্য আমাদের পরিবার ছেড়ে যেতে হয়েছিল। কিন্তু, সেইসময় যিহোবা আমাদের যত্ন নিয়েছিলেন এবং প্রচুর আশীর্বাদ করেছিলেন। আর এর ফলে আমরা নতুন জায়গায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। এই বার আমাদের ঘানায় পাঠানো হয়েছিল।
অ্যান: লাইবেরিয়া ছাড়ার সময় আমরা খুব কেঁদেছিলাম। কিন্তু, এরপর একজন বয়স্ক ভাই ফ্র্যাঙ্ক আমাদের বলেছিলেন, “আপনারা আমাদের ভুলে যান।” এটা শুনে আমরা অবাক হয়ে যাই। কিন্তু, এরপর তিনি আমাদের বোঝান, “আমি জানি, আপনারা আমাদের কখনো ভুলতে পারবেন না। কিন্তু, নতুন জায়গায় মন দিয়ে সেবা করুন। এই কার্যভার যিহোবা আপনাদের দিয়েছেন। তাই সেখানকার ভাই-বোনদের প্রতি মনোযোগ দিন আর তাদের সাহায্য করুন।” সেই ভাইয়ের পরামর্শ অনেক ভালো ছিল। আমরা আবারও এক নতুন জায়গায় গিয়ে নতুন বন্ধু তৈরি করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম।
পল: খুব দ্রুত আমরা ঘানাতে আবারও নতুন পরিবার তৈরি করি। সেখানে অনেক ভাই-বোন ছিল। তাদের বিশ্বাস অনেক দৃঢ় ছিল এবং সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তারা বিশ্বস্ত ছিল। তাদের কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছিলাম। ঘানায় ১৩ বছর সেবা করার পর আমরা আরও একটা খবর পাই। আমাদের বলা হয়, আমরা যেন পূর্ব আফ্রিকার শাখা অফিসে গিয়ে সেবা করি, যেটা কেনিয়ায় অবস্থিত ছিল। ঘানা ও লাইবেরিয়ার ভাই-বোনদের কথা আমাদের খুব মনে পড়ত। কিন্তু, কেনিয়ায় গিয়ে আমরা খুব কম সময়ের মধ্যে নতুন বন্ধু তৈরি করি। এখনও পর্যন্ত আমরা কেনিয়ায় সেবা করছি আর এখানে অনেক কাজ বাকি রয়েছে।
২০২৩ সালে কেনিয়ায় নতুন বন্ধুদের সঙ্গে
যিহোবা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছিলেন
অ্যান: আমরা জীবনে বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছি। এটা আমার শরীর এবং আমার চিন্তাভাবনার উপর অনেক খারাপ প্রভাব ফেলেছে। যিহোবা অলৌকিক উপায়ে আমাদের সমস্যাগুলো থেকে উদ্ধার করেন না। এখনও আমি যদি কোথাও গুলির শব্দ শুনি, তা হলে আমি অনেক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি এবং আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। কিন্তু, আমাদের সাহস বৃদ্ধি করার জন্য যিহোবা আমাদের অনেক কিছু দিয়েছেন, যেমন তিনি আমাদের এত প্রেমময় ভাই-বোন দিয়েছেন। আমি দেখেছি, আমরা যদি ক্রমাগত অধ্যয়ন ও প্রার্থনা করি, সভা ও প্রচার কাজ চালিয়ে যাই, তা হলে আমরা যিহোবার সেবা করে চলার জন্য সাহস লাভ করব।
পল: কিছু লোক জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি মিশনারি সেবা পছন্দ করেন?” আমি তাদের বলি, বিভিন্ন দেশ খুবই সুন্দর, কিন্তু পরিস্থিতি যেকোনো সময়ে পরিবর্তন হতে পারে এবং সমস্যা আসতে পারে। তাই আমরা জায়গার চেয়ে ভাই-বোনদের আরও বেশি ভালোবাসি এবং তারাই হল আমাদের পরিবার। যদিও আমরা আলাদা আলাদা পরিবেশ ও জায়গায় বড়ো হয়ে উঠেছি, কিন্তু আমাদের চিন্তাভাবনা একই ধরনের। আমাদের ভাই-বোনদের উৎসাহিত করার জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু, সত্যটা হল তাদের কাছ থেকে আমি নিজেই উৎসাহিত হই।
আমরা যেখানেই গিয়েছিলাম, সেখানেই ভাই-বোনেরা আমাদের কাছে পরিবারের মতো হয়ে উঠেছিল। এটা কোনো অলৌকিক কাজের চেয়ে কম কিছু নয়। আমরা যত দিন পর্যন্ত যিহোবার মণ্ডলীর অংশ হয়ে থাকব, ততদিন পর্যন্ত আমাদের কাছে থাকার জন্য একটা সুন্দর বাড়ি রয়েছে। আমরা নিশ্চিত যে, আমরা যদি যিহোবার উপর নির্ভর করি, তা হলে তিনি আমাদের প্রয়োজনীয় সাহস ও শক্তি জোগাবেন।—ফিলি. ৪:১৩.
a ভাই জন চেরুকের জীবনকাহিনি পড়ার জন্য ১৯৭৩ সালের ১৫ মার্চ প্রহরীদুর্গ পত্রিকার “I Am Grateful to God and Christ” শিরোনামের প্রবন্ধটা পড়ুন।