জীবনকাহিনি

“এখন আমার প্রচার করতে খুব ভালো লাগে!”

“এখন আমার প্রচার করতে খুব ভালো লাগে!”

নিউজিল্যান্ডের ব্যালক্লুথা শহরে আমি বড়ো হয়ে উঠি। আমি যখন ছোটো ছিলাম, তখন যিহোবাকে একজন বন্ধু হিসেবে দেখতাম আর একজন যিহোবার সাক্ষি হওয়ায় আনন্দিত ছিলাম। সভায় যেতে এবং ভাই-বোনদের সঙ্গে মেলামেশা করতে আমার খুব ভালো লাগত। লাজুক স্বভাবের হলেও, আমি প্রতি সপ্তাহে প্রচারে যাওয়া অনেক উপভোগ করতাম। আমি আমার সহপাঠী এবং অন্যদের কাছে প্রচার করতে ভয় পেতাম না। একজন সাক্ষি হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে আমি গর্ব বোধ করতাম। ১১ বছর বয়সে আমি যিহোবার কাছে নিজের জীবন উৎসর্গ করি।

আমি প্রচার কাজে আনন্দ হারিয়ে ফেলি

দুঃখের বিষয় হল, বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যিহোবার প্রতি আমার ভালোবাসা কমে যেতে শুরু করে। এটা সেই সময়কার কথা, যখন আমার বয়স ১৩ বছর। আমি দেখতাম, আমার স্কুলের সহপাঠীরা স্বাধীনভাবে যেকোনো সময়ে যেখানে-সেখানে যেতে পারত আর তাদের বাবা-মাও কিছু বলত না। আমিও তাদের মতো হতে চাইতাম। আমি মনে করতে শুরু করি, বাড়িতে বাবা-মা যে-নিয়ম স্থির করেছেন, সেগুলো মেনে চলা আর একজন যিহোবার সাক্ষি হওয়া সহজ বিষয় নয়। এখন প্রচার করা এবং সভায় যাওয়া বোঝা বলে মনে হয়। এটা ঠিক যে, আমি কখনো যিহোবার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলিনি, তবে ধীরে ধীরে তাঁর কাছ থেকে আমি দূরে চলে যেতে থাকি।

আমি প্রচারে যাওয়া বন্ধ করিনি ঠিকই, কিন্তু শুধু যেতে হয় বলে যেতাম আর যখন যেতাম, তখন প্রস্তুতি ছাড়াই যেতাম। কারো সঙ্গে কথা বলতে শুরু করা এবং তা চালিয়ে যাওয়া খুব কঠিন বলে মনে হত। ফলে, আমার কাছে কোনো পুনর্সাক্ষাৎ অথবা বাইবেল অধ্যয়ন ছিল না। প্রচার করতে আমার একদম ভালো লাগত না। আমি চিন্তা করতাম, ‘লোকেরা কীভাবে সারা সপ্তাহ ধরে প্রচার করে?’

আমার বয়স যখন ১৭ বছর, তখন আমি নিজেকে আর আটকাতে পারিনি। আমার মধ্যে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। তাই, আমি আমার জামাকাপড় ও জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে রওনা দিই। বাবা-মায়ের পক্ষে এগুলো সহ্য করা সহজ ছিল না। তারা আমার জন্য খুব চিন্তা করতেন। কিন্তু, তারা নিশ্চিত ছিলেন যে, আমি কখনো যিহোবার সেবা বন্ধ করব না।

অস্ট্রেলিয়ায় আমার পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়। আমি সভাতে মাঝেমধ্যে যেতাম। আমি এমন ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করি, যাদের কখনো সভায় দেখা যেত, কখনো-বা নাইটক্লাবে। সত্যি বলতে কী, মদ খাওয়া, নাচ-গান করাই ছিল তাদের জীবন। আমি দুই নৌকায় পা দিয়ে চলছিলাম। একটা পা জগতে, আরেকটা সত্যে। সত্যিই বলতে কী, না আমি এদিকে ছিলাম, না ওদিকে।

আমি এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা লাভ করি

প্রায় দু-বছর পর আমার জীবনে এক নতুন মোড় আসে। আমি পাঁচ জন অবিবাহিত বোনের সঙ্গে একটা বাড়িতে থাকতে শুরু করি। একবার সীমা অধ্যক্ষ এবং তার স্ত্রী তামারাকে, এক সপ্তাহের জন্য এখানে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানাই। সেই কটা দিন আমার জন্য খুবই রোমাঞ্চকর ছিল। তামারা অজান্তেই আমাকে চিন্তা করতে পরিচালিত করেছিলেন যে, আমি কী ধরনের জীবনযাপন করছি। সীমা অধ্যক্ষ ভাই যখন মণ্ডলীর কাজে ব্যস্ত থাকতেন, তখন বোন তামারা আমাদের সঙ্গে সময় কাটাতেন। তিনি অনেক কথা বলতেন আর আমাদের হাসাতেনও। তিনি আমাদের বন্ধুর মতো হয়ে উঠেছিলেন। ফলে, আমরা একে অপরের সঙ্গে খোলাখুলিভাবে কথা বলতাম। আমার এটা দেখে ভালো লাগত যে, সেই বোন যিহোবার সেবায় এত ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও, আমাদের সঙ্গে আনন্দ করছেন।

সত্য ও প্রচারের ব্যাপারে তামারার প্রচুর উদ্যোগ ছিল। তিনি যিহোবার সেবা মনপ্রাণ দিয়ে করতেন এবং অনেক খুশি থাকতেন। কিন্তু আমি, করতে হয় বলে তাঁর সেবা করছিলাম এবং খুশিও ছিলাম না। তার উদ্যোগ দেখে আমিও উদ্যোগী হয়ে উঠি। তামারাকে দেখে আমার বাইবেলের একটা পদ মনে পড়ে যায়: যিহোবা চান যেন আমরা “সানন্দে” এবং “আনন্দগানসহ” তাঁর সেবা করি।—গীত. ১০০:২.

আমি প্রচার কাজে আবারও আনন্দ ফিরে পাই

আমিও তামারার মতো খুশি থাকতে চাইতাম, কিন্তু সেই খুশি পাওয়ার জন্য আমাকে বড়ো বড়ো পরিবর্তন করতে হত। একটু সময় লেগেছিল ঠিকই, কিন্তু ধীরে ধীরে আমি আমার জীবনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করি। আমি প্রচারে যাওয়ার আগে প্রস্তুতি নিই আর মাঝে মাঝে সহায়ক অগ্রগামীর কাজ করি। সেইসময় থেকে আমি প্রচারে কম ঘাবড়ে যাই এবং আস্থা সহকারে কথা বলি আর প্রায়ই লোকদের বাইবেল থেকে পদ দেখাই। ফলে, আমি ভিতর থেকে আনন্দ অনুভব করি। এরপর, আমি প্রতি মাসে সহায়ক অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে শুরু করি।

আমি সব বয়সের ভাই-বোনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে শুরু করি। তারা সত্যে মজবুত ছিল এবং আনন্দের সঙ্গে যিহোবার সেবা করত। তাদের কাছ থেকে আমি শিখেছি যে, জীবনে কোন বিষয়গুলোকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। আমি প্রতিদিন বাইবেল পড়তে শুরু করি আর পরবর্তী সময়ে, আমি একজন নিয়মিত অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে শুরু করি। এত বছর পর বুঝতে পারি, আমি হারিয়ে যাইনি। আমি সত্যিই খুশি আর ভাই-বোনেরা এখন আমার আপন বলে মনে হয়।

আমি এক স্থায়ী অগ্রগামী সাথি খুঁজে পাই

এক বছর পর অ্যালেক্স নামে একজন ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়। অ্যালেক্স খুবই ভালো মানুষ এবং যিহোবাকে খুব ভালোবাসেন আর সেইসঙ্গে প্রচার করতে ভালোবাসেন। অ্যালেক্স একজন পরিচারক দাস ছিলেন এবং ছয় বছর ধরে একজন অগ্রগামী হিসেবে সেবা করেছিলেন। এ ছাড়া, অ্যালেক্স কিছু সময়ের জন্য মালাউইতে সেবা করেছিলেন, যেখানে প্রকাশকদের বেশি প্রয়োজন ছিল। সেখানে তার সঙ্গে কিছু মিশনারির দেখা হয়, যারা তাকে এভাবে যিহোবার সেবাকে জীবনে প্রথম স্থানে রাখার জন্য উৎসাহিত করে।

২০০৩ সালে অ্যালেক্সের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। সেই সময় থেকে আমরা দু-জনেই পূর্ণসময়ের সেবা চালিয়ে যাচ্ছি। আর এই সেবা করে চলার সময়ে আমরা জীবনে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি এবং যিহোবাও আমাদের প্রচুর আশীর্বাদ দিয়েছেন, যেগুলো আমরা গুনে শেষ করতে পারব না।

আরও আশীর্বাদ লাভ করি

তিমর-লেস্তের গ্লেনো শহরে প্রচার করার সময়

আমরা ২০০৯ সালে ইন্দোনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জে, তিমর-লেস্তে নামে একটা ছোটো দেশে মিশনারি হিসেবে সেবা করার আমন্ত্রণ পাই। এই খবর শুনে আমরা অবাক হয়ে যাই আর সেইসঙ্গে কিছুটা ঘাবড়েও যাই। পাঁচ মাস পর আমরা জাতীয় রাজধানী ডিলীতে পৌঁছাই।

এখানে আমাদের জীবন একেবারে আলাদা ছিল। সংস্কৃতি, ভাষা, খাবারদাবার এবং জীবনযাপনের ধরনের সঙ্গে আমাদের মানিয়ে নিতে হয়েছিল। আগের মতো সুযোগসুবিধা ছিল না। প্রচারে বেশিরভাগ এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা হত, যারা খুব গরিব, বেশি লেখাপড়া জানে না এবং অত্যাচারের শিকার হয়েছে। অনেক আগে সেখানে যে-যুদ্ধ হয়েছিল, সেটার জন্য তারা খুবই কষ্টের মধ্যে ছিল। a

এখানে প্রচার করে আমরা ভালো ফলাফল পেয়েছি। আমি একটা অভিজ্ঞতা বলি। একবার, মারিয়া b নামে ১৩ বছর বয়সি এক মেয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়। ও সবসময় হতাশ হয়ে থাকত। কয়েক বছর আগে ওর মা মারা গিয়েছিল আর বাবার সঙ্গে ওর খুব একটা দেখা হত না। মারিয়া ওর বয়সি ছেলে-মেয়েদের মতো কোনোরকমে বেঁচে ছিল; ভবিষ্যতের কোনো লক্ষ্যই ছিল না। আমার মনে আছে, একবার মারিয়া মনের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলে। তবে, আমি ওর কথাগুলো বুঝতে পারিনি কারণ তখনও আমি ওর ভাষা ঠিকমতো শিখিনি। আমি যিহোবার কাছে প্রার্থনা করি, যেন তিনি আমাকে সাহায্য করেন, যাতে আমি ওকে সান্ত্বনা দিতে পারি। তারপর, ওকে বাইবেল থেকে কিছু পড়ে শোনাই। কয়েক বছর পর আমি দেখি, সত্য শেখার ফলে মারিয়া একেবারে পালটে গিয়েছে। এখন ও আর আগের মতো হতাশ হয়ে থাকে না। ওর পোশাক-আশাক, ওর জীবনধারা, সবই পালটে গিয়েছে। ও বাপ্তিস্ম নিয়েছে আর এখন অন্যদের বাইবেল অধ্যয়ন করাচ্ছে। আজ মারিয়ার কাছে এক বড়ো ভ্রাতৃসমাজ রয়েছে আর ও খুব আনন্দে জীবন কাটাচ্ছে।

যিহোবা তিমর-লেস্তেতে প্রচার কাজের উপর আশীর্বাদ করছেন। যদিও এখানকার বেশিরভাগ প্রকাশক গত ১০ বছরের মধ্যে বাপ্তিস্ম নিয়েছে, কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই অগ্রগামী, পরিচারক দাস কিংবা প্রাচীন হিসেবে সেবা করছে। অন্যেরা আবার, শাখা থেকে দূরবর্তী অনুবাদ অফিসে কাজ করছে এবং স্থানীয় ভাষায় প্রকাশনাদি অনুবাদ করছে। আমি যখন দেখি, তারা সভাতে আনন্দের সঙ্গে গান গাইছে এবং যিহোবার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছে, তখন আমি খুবই আনন্দিত হই।

আগে প্রচার করা হয়নি এমন এলাকায় আমি অ্যালেক্সের সঙ্গে স্মরণার্থ সভার আমন্ত্রণপত্র বিতরণ করতে যাচ্ছি

এইরকম জীবন আপনি আর কোথাও খুঁজে পাবেন না

অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে এখানে আমাদের প্রচার করতে আরও ভালো লাগত। তবে, কিছু সমস্যাও ছিল। যেমন, আমাদের এমন এক ছোটো ভিড় বাসে যাতায়াত করতে হত, যেখানে লোকেরা মাছ এবং শাকসবজি নিয়ে উঠত আর তা থেকে অনেক গন্ধ বের হত। আবার আমাদের এমন ঘরগুলোতে বাইবেল অধ্যয়নের জন্য যেতে হত, যেগুলো খুব ছোটো ছিল, ফলে ভিতরটা প্রচণ্ড গরম থাকত। এ ছাড়া, মেঝে খুব নোংরা থাকত এবং আশেপাশে মুরগি ঘুরে বেড়াত। কিন্তু, এসব সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আমি মনে করতাম, ‘এই জীবনটা দারুণ!’

প্রচারে যাওয়ার পথে

আমি যখন আমার ছোটোবেলার কথা চিন্তা করি, তখন বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ে। আমি এখন খুব খুশি যে, তারা আমাকে যিহোবার সেবা করতে সাহায্য করেছিলেন, এমনকী তখনও, যখন আমার প্রচারে এবং সভায় যেতে ভালো লাগত না। আমার জীবনে হিতোপদেশ ২২:৬ পদের কথাগুলো সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। আমি ও অ্যালেক্স যে একসঙ্গে যিহোবার সেবা করে যাচ্ছি, এটা দেখে তারা দু-জনেই অনেক খুশি। ২০১৬ সাল থেকে আমরা অস্ট্রেলেশিয়া শাখার অধীনে এলাকাগুলোতে সীমার কাজ করে আসছি।

তিমর-লেস্তের কয়েক জন ছোটো ছেলে-মেয়ে জেসন ও জেসিকার ভিডিও দেখছে

এখন আমার প্রচার করতে খুব ভালো লাগে। আমি বিশ্বাসই করতে পারি না, একসময় এই কাজই করতে আমার ভালো লাগত না। আমাদের জীবনে যেকোনো সমস্যা আসুক না কেন, মনপ্রাণ দিয়ে যিহোবার সেবা করার ফলেই আমরা প্রকৃত আনন্দ খুঁজে পাব, এই বিষয়টা আমি আমার জীবন থেকে শিখেছি। গত ১৮ বছর ধরে, আমি ও আমার স্বামী আনন্দের সঙ্গে যিহোবার সেবা করে যাচ্ছি। গীতরচক দায়ূদের সঙ্গে আমি এখন একমত, যিনি যিহোবাকে বলেছিলেন: “তোমার শরণাপন্ন সকলে আহ্লাদিত হউক, তাহারা চিরকাল আনন্দগান করুক, . . . যাহারা তোমার নাম ভালবাসে, তাহারা তোমাতে উল্লাস করুক।”—গীত. ৫:১১.

এই ধরনের নম্র ব্যক্তিদের বাইবেল থেকে শেখাতে খুব ভালো লাগে!

a ১৯৭৫ সালের শুরুর দিকে তিমর-লেস্তেতে রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য এক যুদ্ধ শুরু হয়, যেটা ২০ বছর ধরে চলে ছিল।

b নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।