সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

প্রিয়জনদের আনুগত্য থেকে উপকার লাভ করা

প্রিয়জনদের আনুগত্য থেকে উপকার লাভ করা

জীবন কাহিনী

প্রিয়জনদের আনুগত্য থেকে উপকার লাভ করা

বলেছেন ক্যাথলিন কুক

 উনিশশো এগারো সালে, স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে থাকা আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করার সময়, আমার দিদিমা মেরি আ্যলেন থম্পসন, বাইবেল ছাত্রদের একজন বিশিষ্ট সদস্য চার্লস টেজ রাসেলের একটা বক্তৃতায় যোগ দিয়েছিলেন। পরে বাইবেল ছাত্ররা যিহোবার সাক্ষি হিসেবে পরিচিত হয়েছিল। দিদিমা সেই বক্তৃতায় যা শুনেছিলেন, তাতে তিনি রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে এসে, তিনি স্থানীয় বাইবেল ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। ১৯১৪ সালের এপ্রিল মাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত বাইবেল ছাত্রদের প্রথম সম্মেলনে বাপ্তিস্ম নেওয়া ১৬ জনের মধ্যে তিনি একজন ছিলেন। দিদিমার মেয়ে অর্থাৎ আমার মা, এডিথের বয়স তখন ছয় বছর ছিল।

১৯১৬ সালে ভাই রাসেলের মৃত্যুর পর, পৃথিবীব্যাপী বাইবেল ছাত্রদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা গিয়েছিল। ডার্বানে বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা কমে ৬০ থেকে প্রায় ১২ হয়েছিল। ঠাকুরমা ইঙ্গেবর্গ মিরডাল ও তার এক কিশোর ছেলে হেনরি, যে সম্প্রতি বাপ্তাইজিত হয়েছে সে অনুগত ব্যক্তিদের পক্ষ নিয়েছিলেন। ১৯২৪ সালে, হেনরি একজন কল্পটর হয়েছিলেন, যিহোবার সাক্ষিদের পূর্ণসময়ের পরিচারকদের তখন এই নামে ডাকা হতো। পরবর্তী পাঁচ বছর ধরে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক জায়গায় প্রচার করেছিলেন। ১৯৩০ সালে হেনরি ও এডিথ বিয়ে করেন আর এর তিন বছর পর আমার জন্ম হয়।

এক বড় পরিবার

কিছুদিনের জন্য আমরা মোজাম্বিকে বসবাস করি কিন্তু ১৯৩৯ সালে আমরা জোহান্সবার্গে দাদু-দিদিমার বাড়িতে চলে যাই। যদিও বাইবেলের সত্য সম্বন্ধে দাদুর কোনো আগ্রহ ছিল না আর কখনো কখনো তিনি দিদিমার বিরোধিতা করতেন কিন্তু তিনি অতিথিপরায়ণ ছিলেন। ১৯৪০ সালে আমার বোন থেলমার জন্ম হয় এবং আমি ও আমার বোন বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রয়োজনগুলোর যত্ন নিতে শিখি। রাতের খাওয়ার সময়টা প্রায়ই অনেকক্ষণ ধরে চলত কারণ আমরা সবাই একে অন্যকে সারাদিনের ঘটনাগুলো বলতাম অথবা অতীতের স্মৃতিচারণ করতাম।

আমাদের পরিবার পরিদর্শন করতে আসা সেইসমস্ত সাক্ষির, বিশেষ করে যারা পূর্ণসময় পরিচর্যায় রয়েছে তাদের সাহচর্য উপভোগ করত। তারা আমাদের রাতের খাওয়ার সময় কথাবার্তায় অংশ নিত আর তাদের কথাবার্তা আমরা যে-আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার লাভ করেছিলাম, সেটার প্রতি আমাদের উপলব্ধিকে বাড়াত। এটা থেলমা ও আমার মধ্যে তাদের মতো অগ্রগামী হওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে জোরালো করে তুলেছিল।

একেবারে ছোটবেলা থেকেই আমরা পড়ার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পেতে শিখেছিলাম। মা, বাবা এবং দিদিমা প্রত্যেকেই ভাল গল্পবই অথবা সরাসরি বাইবেল থেকেই আমাদের পড়ে শোনাত। খ্রিস্টীয় সভাগুলো ও পরিচর্যা আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। বাবা জোহান্সবার্গের একটা মণ্ডলীতে কোম্পানি দাস (এখন বলা হয় পরিচালক অধ্যক্ষ) ছিলেন, তাই আমাদের অনেক আগেই সভাগুলোতে উপস্থিত থাকতে হতো। যখন আমাদের কোনো সম্মেলন থাকত, তখন বাবা সম্মেলনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কাজকর্ম দেখাশোনায় ব্যস্ত থাকতেন আর মা সম্মেলনে আসা ব্যক্তিদের থাকার ব্যাপারে সাহায্য করতেন।

আমাদের জন্য এক বিশেষ সম্মেলন

১৯৪৮ সালে জোহান্সবার্গে অনুষ্ঠিত সম্মেলনটি ছিল এক বিশেষ সম্মেলন। প্রথমবারের মতো, নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে যিহোবার সাক্ষিদের প্রধান কার্যালয়ের সদস্যরা সেখানে উপস্থিত ছিল। নেথেন নর এবং মিলটন হেনশেল সেখানে থাকাকালীন সময়ে বাবাকে তাদের গাড়ির চালক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। সেই সম্মেলনে আমি বাপ্তিস্ম নিই।

তার কিছুদিন পর, বাবাকে অবাক করে দিয়ে তার বাবা অর্থাৎ আমার ঠাকুরদাদা বলেছিলেন যে, ভাই রাসেলের মৃত্যুর পর যারা বাইবেল ছাত্রদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে তিনি অত্যন্ত দুঃখিত। কয়েক মাস পরে তিনি মারা যান। অন্যদিকে, ঠাকুরমা শেষ পর্যন্ত অনুগত থেকে ১৯৫৫ সালে তার পার্থিব জীবন শেষ করেন।

যে-ঘটনাগুলো আমার জীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল

আমি ১৯৪৯ সালের ১লা ফেব্রুয়ারিতে একজন নিয়মিত অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে শুরু করি। যখন ঘোষণা করা হয়েছিল যে, পরের বছর নিউ ইয়র্ক শহরে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে, তখন আমরা খুবই রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। আমাদের যাওয়ার খুবই ইচ্ছে ছিল কিন্তু সাধ্য ছিল না। তারপর, ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দাদু মারা যান আর দিদিমা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া অর্থ আমাদের পাঁচ জনের যাওয়া-আসার জন্য ব্যবহার করেন।

আমরা সেখানে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে, নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে যিহোবার সাক্ষিদের বিশ্ব প্রধান কার্যালয় থেকে একটা চিঠি আসে। সেটা ছিল আমার জন্য ১৬তম মিশনারি গিলিয়েড স্কুলে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণপত্র। সেটা কতই না রোমাঞ্চকর ছিল, কারণ তখনও আমার বয়স ১৭ বছর হয়নি। যখন ক্লাস শুরু হয়, দেখা যায় যে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা দশজনের মধ্যে আমি ছিলাম ও সেই বিশেষ সুযোগ উপভোগ করছিলাম।

১৯৫১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের গ্র্যাজুয়েশনের পর আমাদের মধ্যে আটজন মিশনারি হিসেবে সেবা করার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকাতে ফিরে যাই। পরবর্তী কয়েক বছর, আমি ও আমার সঙ্গী বেশির ভাগ সময়ে ছোট শহরগুলোতে প্রচার করি, যেখানে আফ্রিকান্স ভাষায় কথা বলা হতো। প্রথম প্রথম, আমি সেই ভাষায় কথা বলতে পারতাম না আর আমার মনে আছে যে একদিন আমি পরিচর্যায় আমার অযোগ্যতার কথা ভেবে কাঁদতে কাঁদতে সাইকেলে করে বাড়ি ফিরেছিলাম। কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি উন্নতি করি এবং যিহোবা আমার প্রচেষ্টায় আশীর্বাদ করেন।

বিয়ে ও ভ্রমণের কাজ

১৯৫৫ সালে জন কুকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ও পরে ফ্রান্স, পর্তুগাল এবং স্পেনে প্রচার কাজ শুরু করতে সাহায্য করেছিল এবং যে-বছর তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, সেই বছরেই সে একজন মিশনারি হিসেবে আফ্রিকাতে এসেছিল। পরবর্তীকালে সে লিখেছিল: “এক সপ্তাহে আমার জীবনে তিনটে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে . . . খুব উদার একজন ভাই আমাকে একটা ছোট্ট গাড়ি উপহার দেন; আমি একজন জেলা দাস হিসেবে নিযুক্ত হই; আর আমি প্রেমে পড়ি।” * আমরা ১৯৫৭ সালের ডিসেম্বর মাসে বিয়ে করি।

আমাদের বিবাহপূর্ব মেলামেশার সময় জন আমাকে আশ্বাস দিয়েছিল যে, তার সঙ্গে আমার জীবন কখনোই একঘেয়ে হবে না আর সে ঠিক কথাই বলেছিল। আমরা দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়ে মণ্ডলীগুলো, যেখানে মূলত কৃষ্ণাঙ্গ লোকেরা বাস করত, পরিদর্শন করেছিলাম। প্রতি সপ্তাহে, ওই এলাকাগুলোতে শুধুমাত্র প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য আমাদেরকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হতো আর রাতে থাকার অনুমতি পাওয়া যে কত ঝামেলা ছিল তা তো বলাই বাহুল। কদাচিৎ আমরা শ্বেতাঙ্গ লোকেদের এলাকায় কোনো একটা খালি দোকান ঘরের মেঝেতে ঘুমাতাম, যেখানে আমরা চেষ্টা করতাম যেন পথচারীদের নজরে না পড়ি। সাধারণত আমাদেরকে শ্বেতাঙ্গ সাক্ষিদের কাছাকাছি থাকতে হতো, যারা প্রায়ই বহু কিলোমিটার দূরে বসবাস করত।

এ ছাড়া, আমরা একেবারে জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত অত্যন্ত সাদামাটা সম্মেলনস্থলের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখিও হতাম। আমরা যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা তৈরি চলচ্চিত্রগুলো দেখিয়েছিলাম, যেগুলো আমাদের বিশ্বব্যাপী ভ্রাতৃসমাজের প্রতি লোকেদের উপলব্ধি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। যেহেতু সেই এলাকাগুলোতে কোনো বিদ্যুৎ ছিল না, তাই আমরা আমাদের নিজস্ব জেনারেটর নিয়ে গিয়েছিলাম। এ ছাড়া, আমাদেরকে জুলু ভাষা শেখার প্রতিদ্বন্দ্বিতার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ অধ্যুষিত রাজ্যগুলোতে বিভিন্ন সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছিল, যেখানে আমাদের প্রকাশনা তখন নিষিদ্ধ ছিল। তবুও, আমরা আমাদের ভাইদের সেবা করতে পেরে আনন্দিত হয়েছিলাম।

১৯৬১ সালের আগস্ট মাসে, জন দক্ষিণ আফ্রিকাতে অনুষ্ঠিত চার সপ্তাহ ব্যাপী কিংডম মিনিস্ট্রি স্কুল এর প্রথম নির্দেশক হিসেবে নিযুক্ত হয়, যা মণ্ডলীর অধ্যক্ষদের সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। সে শিক্ষাদানে দক্ষ ছিল এবং সহজ যুক্তি ও প্রাণবন্ত দৃষ্টান্ত দিয়ে হৃদয়ে পৌঁছাতে পারত। প্রায় দেড় বছর ধরে, আমরা ধারাবাহিকভাবে ইংরেজি ভাষায় অনুষ্ঠিত ক্লাসের জন্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ভ্রমণ করেছিলাম।। জন যখন শিক্ষা দিত, আমি স্থানীয় সাক্ষিদের সঙ্গে ক্ষেত্রের পরিচর্যায় অংশ নিতাম। তারপর, ১৯৬৪ সালের ১লা জুলাই আমাদের অবাক করে দিয়ে একটা চিঠি আসে, যেটাতে আমাদেরকে জোহান্সবার্গের কাছে দক্ষিণ আফ্রিকার শাখা অফিসে সেবা করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।

কিন্তু, সেই সময় থেকে জনের স্বাস্থ্য আমাদের চিন্তায় ফেলতে শুরু করে। ১৯৪৮ সালে তার যক্ষ্মা হয় আর তারপর থেকে সে প্রায়ই দুর্বল বোধ করতে থাকে। তার সর্দি জ্বরের মতো লক্ষণ দেখা দিত আর একেক বার কয়েক দিনের জন্য অসুস্থ থাকত—সে কোনোকিছুই করতে পারত না বা কারো সঙ্গে দেখা করত না। শাখা অফিস আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানানোর কিছুদিন আগে আমরা যে-ডাক্তারকে দেখিয়েছিলাম, তিনি জনের সমস্যাকে বিষণ্ণতাজনিত সমস্যা বলে চিহ্নিত করেন।

ডাক্তারের পরামর্শ মতো, আমাদের কর্মোদ্যম জীবনের গতি পরিবর্তন করার কথা আমরা ভাবতেই পারিনি। শাখা অফিসে জনকে সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে আর আমাকে প্রুফরিডিং করার কাজে নিযুক্ত করা হয়। আর আমাদের নিজেদের একটা রুম থাকা কী এক আশীর্বাদই না ছিল! আমাদের বিয়ের আগে, জন পর্তুগিজ এলাকাতে সেবা করেছিল, তাই ১৯৬৭ সালে আমাদেরকে জোহান্সবার্গের পার্শ্ববর্তী বিশাল পর্তুগিজ সমাজের কাছে প্রচার করার জন্য সেখানকার একমাত্র স্থানীয় পর্তুগিজ সাক্ষি পরিবারকে সাহায্য করতে বলা হয়। আমার জন্য এর মানে ছিল আরও একটা ভাষা শেখা।

যেহেতু পর্তুগিজ সমাজ এক বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল, তাই যোগ্য ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছানোর জন্য আমাদেরকে অনেক ভ্রমণ করতে হতো, কখনো কখনো প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। সেই সময়ের দিকে, মোজাম্বিক থেকে পর্তুগিজ-ভাষী সাক্ষিরা সম্মেলনের সময় আমাদের কাছে আসতে শুরু করে, যেটা নতুন ব্যক্তিদের জন্য খুবই সাহায্যকারী ছিল। পর্তুগিজ লোকেদের সঙ্গে ১১ বছর থাকার সময়, আমরা আমাদের ৩০ জনের ছোট্ট দলটিকে বৃদ্ধি পেয়ে চারটে মণ্ডলীতে পরিণত হতে দেখেছি।

বাড়িতে বিভিন্ন পরিবর্তন

ইতিমধ্যে, আমার বাবামার বাড়িতে বিভিন্ন পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৬০ সালে আমার বোন থেলমা, জন আরবান নামে যুক্তরাষ্ট্রের একজন অগ্রগামীকে বিয়ে করে। ১৯৬৫ সালে তারা গিলিয়েডের ৪০তম ক্লাসে যোগ দেয় এবং ২৫ বছর ধরে অনুগতভাবে ব্রাজিলে মিশনারি হিসেবে সেবা করে। ১৯৯০ সালে তারা জনের অসুস্থ বাবামাকে দেখাশোনা করার জন্য ওহাইওতে ফিরে আসে। বাবামাকে দেখাশোনা করার চাপ থাকা সত্ত্বেও, আজও তারা পূর্ণসময়ের পরিচর্যা করে যাচ্ছে।

দিদিমা ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে ১৯৬৫ সালে ৯৮ বছর বয়সে তার পার্থিব জীবন শেষ করেন। সেই বছরেই বাবা তার কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাই যখন জনকে ও আমাকে স্থানীয় পর্তুগিজ ক্ষেত্রে সাহায্য করতে বলা হয়, তখন বাবামা স্বেচ্ছায় আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। তারা দলের মধ্যে এক সুদৃঢ় প্রভাব ফেলেছিলেন এবং কয়েক মাস পরে প্রথম মণ্ডলী গড়ে উঠেছিল। এর অল্প কিছু সময় পরে মা ক্যান্সারের লক্ষণগুলো অনুভব করতে শুরু করেন, যা ১৯৭১ সালে তার জীবন কেড়ে নেয়। তার সাত বছর পরে বাবা মারা যান।

জনের অসুস্থতার সঙ্গে মোকাবিলা করা

১৯৭০ এর দশকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে জনের স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি হচ্ছে না। ধীরে ধীরে তাকে আমাদের শাখা পরিবারের সাপ্তাহিক প্রহরীদুর্গ অধ্যয়ন ও সকালের বাইবেল আলোচনা পরিচালনা করার মতো তার মূল্যবান সুযোগগুলো ছেড়ে দিতে হয়। তার কার্যভার সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট থেকে মেইল রুম এবং তারপর বাগানে পরিবর্তিত হয়।

জনের খিটখিটে স্বভাবের দরুন তার পক্ষে পরিবর্তন করা বেশ কঠিন হয়ে উঠেছিল। যখন আমি তাকে বার বার শান্ত করার চেষ্টা করতাম, তখন সে মজা করে আমাকে তার পায়ের বেড়ি বলে ডাকত—তবে পরক্ষণেই আবার উপলব্ধি দেখিয়ে জড়িয়ে ধরত। শেষ পর্যন্ত আমরা বুঝতে পারি যে, পর্তুগিজ এলাকা থেকে চলে আসা এবং শাখা অফিসের কিংডম হলে যে-মণ্ডলীটি একত্রিত হতো, তাদের সঙ্গে সেবা করাই যুক্তিযুক্ত।

জনের স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যিহোবার সঙ্গে তার সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ হতে দেখা হৃদয়স্পর্শী ছিল। জন যখন খুব বিষণ্ণ হয়ে মাঝরাতে জেগে যেত, তখন আমরা একসঙ্গে ততক্ষণ পর্যন্ত কথা বলতাম, যতক্ষণ না সে যিহোবার সাহায্য চেয়ে প্রার্থনা করার মতো যথেষ্ট শান্ত অবস্থায় ফিরে আসত। শেষে, সে ধীরে ধীরে “কোন বিষয়ে ভাবিত হইও না . . .” ফিলিপীয় ৪:৬, ৭ পদের এই কথাগুলো জোর করে পুনরাবৃত্তি করার দ্বারা একাই সেই খারাপ মুহূর্তগুলোর সঙ্গে মোকাবিলা করত। এরপরই সে যথেষ্ট শান্ত হয়ে প্রার্থনা করতে শুরু করত। প্রায়ই আমি রাতের বেলা জেগে চুপচাপ দেখতাম যে, যিহোবার কাছে ঐকান্তিক প্রার্থনা করার সময় তার ঠোঁট দুটো নড়ছে।

যেহেতু আমাদের শাখা অফিসটি প্রয়োজনের তুলনায় খুব ছোট হয়ে গিয়েছিল, তাই জোহান্সবার্গের বাইরে আরও বড় আকারের নতুন শাখার নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। জন ও আমি প্রায়ই শহরের কোলাহলপূর্ণ এবং দূষণ থেকে অনেক দূরে, এই শান্তিপূর্ণ এলাকায় যেতাম। যখন আমরা নতুন শাখা অফিস নির্মাণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে অস্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি পাই, তখন সেটা জনকে খুবই সাহায্য করেছিল।

নতুন নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতা

জনের চিন্তা ও যুক্তি করার ক্ষমতা যতই দুর্বল হতে থাকে ততই তার পক্ষে তার কাজের দায়িত্ব পালন করা কঠিন হয়ে পড়ে। জনের প্রচেষ্টাকে অন্যেরা যেভাবে সমর্থন করেছিল, তা আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। উদাহরণস্বরূপ, একজন ভাই যখন একটা পাবলিক লাইব্রেরিতে গবেষণার জন্য যেতেন, তখন তিনি জনকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। আর সেইসময় জনের পকেট পত্রিকা আর ট্র্যাক্টে ভরা থাকত। এটা জনকে কিছু সম্পাদন করার ও মূল্যবান বোধ করার অনুভূতি দিত।

শেষ পর্যন্ত আ্যলজিমার্স রোগের কারণে জনের জন্য কোনোকিছু পড়া অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। বাইবেলভিত্তিক সাহিত্যাদির অডিও টেপ ও রাজ্যের গানগুলো থাকায় আমরা কৃতজ্ঞ ছিলাম। আমরা সেগুলো বার বার শুনতাম। যদি আমি তার পাশে বসে সেগুলো না শুনতাম, তা হলে জন প্রায়ই বিরক্ত হয়ে যেত আর তাই ঘন্টার পর ঘন্টা আমি নিজেকে সেলাইয়ের কাজে ব্যস্ত রাখতাম। এর ফলে, আমাদের সোয়েটার ও কম্বলের কোনো অভাব হয়নি!

এর মধ্যে জনের অবস্থার কারণে তার আমার কাছ থেকে আরও যত্নের প্রয়োজন হয়। যদিও কখনো কখনো আমি এত ক্লান্ত থাকতাম যে পড়তে বা অধ্যয়ন করতে কষ্ট হতো কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার জন্য যত্ন নেওয়া আমার জন্য এক বিশেষ সুযোগ ছিল। সেই যত্নের শেষ এসেছিল ১৯৯৮ সালে, যখন জন তার ৮৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পরই শেষ পর্যন্ত অবিচল আনুগত্য বজায় রেখে নিঃশব্দে আমার কোলে মারা যায়। পুনরুত্থানে তাকে দেখার জন্য আমি কতই না সানন্দে প্রতীক্ষা করে আছি, যখন তার স্বাস্থ্য ও চিন্তাশক্তি পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে!

সতেজ হওয়া

জনের মৃত্যুর পর, আমার জন্য একা একা জীবনযাপন করতে শেখা সহজ ছিল না। তাই ১৯৯৯ সালের মে মাসে, আমি যুক্তরাষ্ট্রে আমার বোন থেলমা ও তার স্বামীকে দেখতে গিয়েছিলাম। বিশেষ করে আমরা যখন নিউ ইয়র্কে যিহোবার সাক্ষিদের বিশ্ব প্রধান কার্যালয়ে গিয়েছিলাম, তখন বহু অনুগত, প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা কী এক আনন্দের ও সতেজতাদায়কই না ছিল! নিঃসন্দেহে, এটা আমার জন্য প্রয়োজনীয় এক আধ্যাত্মিক উৎসাহ ছিল।

আমাকে উপকৃত করেছে এমন অনেক বিষয়ের মধ্যে আমার বিশ্বস্ত প্রিয়জনদের জীবনযাপন সম্বন্ধে স্মরণ করা আমার জন্য এক অনুস্মারক হিসেবে কাজ করে। তাদের নির্দেশনা, উদাহরণ আর সাহায্যের মাধ্যমে আমি অন্য দেশের ও জাতির লোকেদের প্রতি প্রেম দেখানোর ক্ষেত্রে প্রশস্ত হতে শিখেছি। আমি ধৈর্য ধরতে, সহিষ্ণু হতে এবং মানিয়ে নিতে শিখেছি। সর্বোপরি, আমি প্রার্থনা শ্রবণকারী যিহোবার করুণা সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। আমারও গীতরচকের মতো একই অনুভূতি হয়, যিনি লিখেছিলেন: “ধন্য সেই, যাহাকে তুমি মনোনীত করিয়া নিকটে আন, সে তোমার প্রাঙ্গণে বাস করিবে; আমরা পরিতৃপ্ত হইব, তোমার গৃহের উত্তম দ্রব্যে।”—গীতসংহিতা ৬৫:৪.

[পাদটীকা]

^ ১৯৫৯ সালের ১লা আগস্ট প্রহরীদুর্গ (ইংরেজি) পত্রিকার ৪৬৮-৭২ পৃষ্ঠা দেখুন।

[৮ পৃষ্ঠার চিত্র]

দিদিমা তার মেয়েদের সঙ্গে

[৯ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৪৮ সালে আমি যখন বাপ্তিস্ম নিই তখন বাবামার সঙ্গে

[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]

গিলিয়েডের রেজিস্ট্রার আ্যলবার্ট শ্রোডার এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা অন্যান্য নয় জন ছাত্রের সঙ্গে

[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৮৪ সালে জনের সঙ্গে