সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

নোহ ‘আর সাত জনের সহিত রক্ষা’ পেয়েছিলেন

নোহ ‘আর সাত জনের সহিত রক্ষা’ পেয়েছিলেন

তাদের বিশ্বাস অনুকরণ করুন

তিনি ‘আর সাত জনের সহিত রক্ষা’ পেয়েছিলেন

নোহ ও তার পরিবার মুষলধারে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনে, একে অন্যের আরও কাছাকাছি এসে বসে। তাদের সম্বন্ধে একটু কল্পনা করুন, প্রদীপের টিমটিম আলোয় তাদের আবছা চেহারা দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টির জল প্রবল বেগে জাহাজের ছাদে পড়ার এবং জাহাজের দেওয়ালে আঘাত করার শব্দ শুনে, তারা অবাক চোখে তাকাচ্ছে। কী ভয়ানক সেই শব্দ!

নোহ যখন তার পরিবারের দিকে অর্থাৎ বিশ্বস্ত স্ত্রী এবং তিন জন বাধ্য ছেলে ও সেইসঙ্গে তাদের স্ত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন, তখন তার হৃদয় নিশ্চয়ই কৃতজ্ঞতায় ভরে গিয়েছিল। সেই কঠিন সময়ে, তিনি হয়তো এটা দেখে অনেক সান্ত্বনা পেয়েছিলেন যে, তিনি যাদেরকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, তারা ঠিক তার সঙ্গেই রয়েছে। তারা সবাই জীবিত ও সুরক্ষিত। তিনি নিশ্চয়ই কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তার পরিবারকে নিয়ে এক প্রার্থনা করেছিলেন আর তা বেশ জোরে জোরেই করেছিলেন, যাতে বাইরের তীব্র আওয়াজ সত্ত্বেও তারা তার কথা শুনতে পায়।

নোহ এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন, যার অগাধ বিশ্বাস ছিল। নোহের এই বিশ্বাসের কারণে, তার ঈশ্বর যিহোবা তাকে ও তার পরিবারকে রক্ষা করতে পরিচালিত হয়েছিলেন। (ইব্রীয় ১১:৭) কিন্তু, যখন বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছিল, তখন কি তাদের বিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে গিয়েছিল? না, এর বিপরীতে, তাদের সামনে যে-কঠিন সময় আসতে যাচ্ছিল, সেখানে তাদের এই গুণের আরও বেশি প্রয়োজন ছিল। বর্তমানে এই অশান্ত সময়ে, আমাদের বিষয়েও একই কথা বলা যেতে পারে। তাই, আসুন আমরা দেখি, নোহের বিশ্বাস থেকে আমরা কী শিখতে পারি।

“চল্লিশ দিবারাত্র”

এদিকে বাইরে “চল্লিশ দিবারাত্র” ধরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছিল। (আদিপুস্তক ৭:৪, ১১, ১২) জল ক্রমশ বেড়েই চলেছিল। সেই সময়ে, নোহ বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর ঈশ্বর যিহোবা একদিকে যেমন ধার্মিক লোকেদের রক্ষা করছেন, তেমনই অন্যদিকে দুষ্ট লোকেদের শাস্তি দিচ্ছেন।

সেই জলপ্লাবন, স্বর্গদূতেদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া বিদ্রোহ রোধ করেছিল। শয়তানের স্বার্থপর মনোভাবের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, অনেক স্বর্গদূত পৃথিবীর নারীদের সঙ্গে সহবাস করার জন্য স্বর্গে তাদের নিজেদের “বাসস্থান ত্যাগ” করেছিল আর সেইসঙ্গে নেফিলিম নামে সংকর-জাতীয় সন্তানদের জন্ম দিয়েছিল। (যিহূদা ৬; আদিপুস্তক ৬:৪) কোনো সন্দেহ নেই যে, সেই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ায় শয়তান খুবই আনন্দিত হয়েছিল, কারণ তা পৃথিবীতে ঈশ্বরের সর্বোত্তম সৃষ্টি মানবজাতিকে আরও কলুষিত করে তুলেছিল।

কিন্তু, প্লাবনের জল বাড়তে থাকায়, সেই বিদ্রোহী স্বর্গদূতেরা তাদের মাংসিক দেহ ত্যাগ করে আত্মিক রাজ্যে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল এবং এরপর তারা আর কখনো সেই মাংসিক দেহ ধারণ করতে পারেনি। সেই বিদ্রোহী স্বর্গদূতেরা তাদের স্ত্রী ও তাদের সন্তানদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল, যাতে তারা অন্যান্য মানুষের সঙ্গে জলপ্লাবনে মারা যায়।

প্রায় সাত-শো বছর আগে সেই হনোকের সময় থেকে, যিহোবা মানবজাতিকে সাবধান করে আসছিলেন যে, তিনি দুষ্ট ও ঈশ্বরভয়হীন লোকেদের ধ্বংস করবেন। (আদিপুস্তক ৫:২৪; যিহূদা ১৪, ১৫) সেই সময়ের পর থেকে লোকেরা আরও মন্দ হয়ে গিয়েছিল এবং পৃথিবীকে নষ্ট করছিল ও এটাকে দৌরাত্ম্যে ভরিয়ে দিয়েছিল। আর এখন তারা ধ্বংসের কবলে পড়েছে। তাদেরকে ধ্বংস করা হচ্ছে জেনে নোহ ও তার পরিবার কি আনন্দ করেছিল?

না। এমনকী তাদের করুণাময় ঈশ্বরও করেননি। (যিহিষ্কেল ৩৩:১১) যিহোবা যত জনকে সম্ভব রক্ষা করার জন্য সবরকম প্রচেষ্টা করেছিলেন। তিনি হনোককে সাবধান করার কার্যভার দিয়েছিলেন এবং নোহকে জাহাজ তৈরি করার আদেশ দিয়েছিলেন। নোহ ও তার পরিবার দশকের পর দশক ধরে লোকেদের চোখের সামনে এই বিশাল কার্যভার সম্পন্ন করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে চলেছিল। শুধু তা-ই নয়, যিহোবা নোহকে “ধার্ম্মিকতার প্রচারক” হিসেবে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। (২ পিতর ২:৫) নোহ তার আগে হনোকের মতো জগতের ওপর যে-বিচার আসতে চলেছে, সেই বিষয়ে লোকেদের সাবধান করেছিলেন। কিন্তু তারা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল? যিশু যিনি স্বর্গ থেকে এই ঘটনাগুলো ঘটতে দেখছিলেন, তিনি পরে নোহের দিনের লোকেদের কথা স্মরণ করে বলেছিলেন যে, তারা “বুঝিতে পারিল না, [“মনোযোগ দিল না,” NW] যাবৎ না বন্যা আসিয়া সকলকে ভাসাইয়া লইয়া গেল।”—মথি ২৪:৩৯.

কল্পনা করুন, যিহোবা সেই জাহাজের দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পর, প্রথম ৪০ দিন নোহ ও তার পরিবারের হয়তো কেমন লেগেছিল। বাইরে যখন দিনের পর দিন প্রবল বৃষ্টিপাত হচ্ছিল, তখন ভিতরে এই আট জন হয়তো ধীরে ধীরে তাদের দৈনন্দিন কাজ করছিল—পরস্পরের যত্ন নেওয়া, তাদের ঘর পরিষ্কার রাখা এবং ভিতরে রাখা জীবজন্তুর যত্ন নেওয়া। কিন্তু হঠাৎ সেই বিরাট জাহাজটা কেঁপে ওঠে। এটা নড়তে শুরু করে। বাড়তে থাকা জলের চাপ জাহাজকে ক্রমশ ওপরের দিকে ঠেলতে থাকে, যতক্ষণ না “তাহা মৃত্তিকা ছাড়িয়া উঠিল।” (আদিপুস্তক ৭:১৭) সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যিহোবার শক্তির কী এক বিস্ময়কর প্রদর্শন!

নোহ নিশ্চয়ই অনেক কৃতজ্ঞ হয়েছিলেন—শুধুমাত্র এই কারণে নয় যে, যিহোবা তাকে ও তার পরিবারকে রক্ষা করেছেন, কিন্তু সেইসঙ্গে সেই লোকেদের সাবধান করার জন্য করুণা দেখিয়ে তাদের ব্যবহার করেছেন, যারা জাহাজের বাইরে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে করা কঠোর পরিশ্রম সেই সময় হয়তো নিষ্ফল বলে মনে হয়েছিল। লোকেরা ছিল খুবই উদাসীন! চিন্তা করুন—খুব সম্ভবত জলপ্লাবন আসার আগে নোহের ভাই, বোন, তাদের ছেলে-মেয়ে বেঁচে ছিল; কিন্তু তার নিজের পরিবার ছাড়া আর কেউই তার কথা শোনেনি। (আদিপুস্তক ৫:৩০) এখন জাহাজের মধ্যে সুরক্ষিত সেই আট জন ব্যক্তি নিশ্চয়ই অতীতের এই বিষয়টা স্মরণ করে সান্ত্বনা পেয়েছিল যে, সেই লোকেদের রক্ষা করার জন্য তারা যথেষ্ট সময় ব্যয় করেছিল।

নোহের সময় থেকে এখন পর্যন্ত যিহোবা পরিবর্তিত হননি। (মালাখি ৩:৬) যিশু খ্রিস্ট আমাদের সময়কালকে অনেকটা ‘নোহের সময়ের’ মতো বলে উল্লেখ করেছিলেন। (মথি ২৪:৩৭) আমাদের সময়টা হল এক বিশেষ সময়, যা অত্যন্ত কষ্টকর আর এটা সেই সময় শেষ হবে, যখন কলুষিত বিধিব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। বর্তমানে, একইভাবে ঈশ্বরের লোকেরাও এমন সকলকে এক সতর্কতামূলক বার্তা জানাচ্ছে, যারা তা শুনতে চায়। আপনি কি সেই বার্তার প্রতি সাড়া দেবেন? আপনি যদি ইতিমধ্যেই সেই জীবনরক্ষাকারী বার্তার সত্য গ্রহণ করে থাকেন, তাহলে আপনি কি তা অন্যদের জানানোর কাজে অংশ নেবেন? এই ক্ষেত্রে, নোহ ও তার পরিবার আমাদের সকলের জন্য এক উদাহরণ স্থাপন করেছে।

“জল দ্বারা রক্ষা পাইয়াছিল”

সেই জাহাজটা যখন উত্তাল সমুদ্রে ভেসে চলছিল, তখন যারা ভিতরে ছিল, তারা সবাই নিশ্চয়ই সেই বিশাল জাহাজের ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। ঢেউগুলো কত বিশাল তা ভেবে কি নোহ ভয় পেয়েছিলেন কিংবা এমনটা মনে করেছিলেন যে, জাহাজটা ভেঙে যাবে? না। বর্তমানে সন্দেহবাদীরা হয়তো এমনটা মনে করতে পারে, কিন্তু নোহ কোনোরকম সন্দেহ করেননি। বাইবেল বলে: “বিশ্বাসে নোহ . . . এক জাহাজ নির্ম্মাণ করিলেন।” (ইব্রীয় ১১:৭) কীসের ওপর বিশ্বাস? যিহোবা নোহ এবং তার সঙ্গে যারা থাকবে, তাদের সকলকে জলপ্লাবন থেকে রক্ষা করার বিষয়ে এক চুক্তি বা নিয়ম স্থির করেছিলেন। (আদিপুস্তক ৬:১৮, ১৯) যিনি এই মহাবিশ্ব, পৃথিবী এবং এর মধ্যে জীবিত সমস্তকিছু সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি এই জাহাজকে সুরক্ষিত রাখতে পারবেন না? নিশ্চয়ই পারবেন! নোহ সঠিকভাবে যিহোবার ওপর আস্থা রেখেছিলেন যে, তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করবেন। আর সত্যিই তিনি ও তার পরিবার ‘জল দ্বারা রক্ষা পাইয়াছিলেন।’—১ পিতর ৩:২০.

৪০ দিন ও ৪০ রাত পার হওয়ার পর, অবশেষে বৃষ্টি পড়া বন্ধ হয়েছিল। আমাদের ক্যালেন্ডার অনুসারে সময়টা ছিল খ্রিস্টপূর্ব ২৩৭০ সালের ডিসেম্বর মাসের কোনো এক দিন। কিন্তু, তখনও সেই পরিবারের জাহাজ ছেড়ে বাইরে বের হয়ে আসার সময় আসেনি। পুরো পৃথিবী তখন জলের তলায় ছিল আর জীবিত প্রাণীতে পূর্ণ সেই জাহাজটা এমনকী পর্বতশৃঙ্গের ওপর ভেসে চলেছিল। (আদিপুস্তক ৭:১৯, ২০) আমরা হয়তো কল্পনা করতে পারি, নোহ তার ছেলে শেম, হাম ও যেফৎকে নিয়ে যথেষ্ট পরিশ্রম করছেন, যাতে তারা সমস্ত পশুকে খাওয়াতে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুস্থ-সবল রাখতে পারেন। অবশ্য এটা ঠিক, যে-ঈশ্বর সমস্ত বন্যজন্তুকে বশে এনে জাহাজে প্রবেশ করিয়েছিলেন, তিনি জলপ্লাবনের সময়ও তাদেরকে একইরকম বশীভূত রাখতে সক্ষম ছিলেন। a

স্পষ্টতই, নোহ যত্নসহকারে এই সমস্ত ঘটনার নথি লিখে রেখেছিলেন। বিবরণ আমাদের জানায় যে, কখন বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছিল ও কখন শেষ হয়েছিল। এ ছাড়া, এটা এও জানায় যে, পৃথিবী ১৫০ দিন জলমগ্ন ছিল। পরিশেষে, জল হ্রাস পেতে শুরু করে। এক স্মরণীয় দিনে, সেই জাহাজটা ‘অরারটের পর্ব্বতে’ এসে থেমে যায়, যা বর্তমান দিনে তুরস্কে অবস্থিত। সেটা ছিল খ্রিস্টপূর্ব ২৩৬৯ সালের এপ্রিল মাস। এর ৭৩ দিন পর জুন মাসে পর্বতশৃঙ্গ দেখা গিয়েছিল। তিন মাস পর, সেপ্টেম্বর মাসে নোহ জাহাজের উপরিভাগ বা ছাদের কোনো অংশ খুলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এটা নিশ্চয়ই বেশ কঠিন কাজ ছিল আর এর ফলে আলো ও মুক্ত বাতাস প্রবেশ করেছিল। এর আগে, নোহ আশেপাশের অবস্থা কতটা নিরাপদ ও বসবাসযোগ্য তা দেখার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি একটা দাঁড়কাক ছেড়েছিলেন, যেটা কয়েক বার যাওয়া-আসা করেছিল, হয়তো-বা এই সময়ের মধ্যে জাহাজের ওপরে কিছুক্ষণ বসেও ছিল; এরপর তিনি একটি কপোত ছেড়েছিলেন, যেটি বার বার নোহের কাছে ফিরে এসেছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না এটি থাকার জন্য একটা স্থায়ী জায়গা পেয়েছিল।—আদিপুস্তক ৭:২৪–৮:১৩.

কোনো সন্দেহ নেই যে, নোহ তার দৈনন্দিন কাজের মধ্যেও আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোকে প্রথম স্থানে রেখেছিলেন। আমরা হয়তো কল্পনা করতে পারি যে, সেই পরিবার নিয়মিতভাবে প্রার্থনা করার ও তাদের সুরক্ষাকারী স্বর্গীয় পিতার বিষয়ে আলোচনা করার জন্য একত্রে মিলিত হতো। নোহ প্রত্যেকটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের জন্য যিহোবার ওপর নির্ভর করতেন। এমনকী প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় জাহাজে থাকার পর যখন নোহ দেখেছিলেন যে, ‘ভূমি শুষ্ক হইয়া গিয়াছে,’ তখনও তিনি নিজে জাহাজের দরজা খোলার চেষ্টা করেননি এবং সেই জাহাজ থেকে বের হওয়ার জন্য নেতৃত্ব দেননি। (আদিপুস্তক ৮:১৪) তিনি যিহোবার আদেশের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন!

আজকের দিনের পরিবারের মস্তকেরা এই বিশ্বস্ত মানুষের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে। নোহ সংযত, পরিশ্রমী ও ধৈর্যশীল ছিলেন এবং যারা তার অধীনে ছিল, তিনি তাদেরকে সুরক্ষা করেছিলেন। সবচেয়ে বড়ো বিষয় হল যে, তিনি যিহোবা ঈশ্বরের ইচ্ছাকে সমস্তকিছুর আগে রেখেছিলেন। এই ক্ষেত্রগুলোতে আমরা যদি নোহের বিশ্বাসকে অনুকরণ করি, তাহলে আমরা সেইসমস্ত ব্যক্তিদের জন্য আশীর্বাদ নিয়ে আসতে পারব, যাদেরকে আমরা ভালোবাসি।

“জাহাজ হইতে বাহিরে যাও”

পরিশেষে, যিহোবা আদেশ দিয়েছিলেন। তিনি নোহকে বলেছিলেন, “তুমি আপনার স্ত্রী, পুত্ত্রগণ ও পুত্ত্রবধূগণকে সঙ্গে লইয়া জাহাজ হইতে বাহিরে যাও।” বাধ্যতা দেখিয়ে সেই পরিবার জাহাজ থেকে বের হয়ে এসেছিল আর সমস্ত জীবজন্তুও তাদের সঙ্গে জাহাজ থেকে বের হয়েছিল। কিন্তু কীভাবে? যে যার মতো হুড়োহুড়ি করে? একেবারেই না! বিবরণ বলে যে, তারা “স্ব স্ব জাতি অনুসারে . . . জাহাজ হইতে বাহির হইল।” (আদিপুস্তক ৮:১৫-১৯) নোহ ও তার পরিবার যখন জাহাজ থেকে বাইরে বের হয়ে এসেছিল, তখন সেই মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিয়ে, অরারট পর্বতের ওপর থেকে তারা সামনে এক পরিষ্কার পৃথিবী দেখতে পেয়েছিল। সেই নেফিলিমরা, তাদের দৌরাত্ম্য, সেইসঙ্গে বিদ্রোহী স্বর্গদূতেরা ও সমগ্র দুষ্ট সমাজ আর ছিল না! b মানুষের সামনে আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করার সুযোগ ছিল।

নোহ জানতেন যে, এখন তাকে কী করতে হবে। তিনি প্রথমেই উপাসনার কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি একটা যজ্ঞবেদি নির্মাণ করেছিলেন ও ঈশ্বরের দৃষ্টিতে শুচি—যেগুলোকে তারা “সাত সাত যোড়া” করে জাহাজে তুলেছিল, সেগুলোর মধ্যে থেকে—কয়েকটি পশু হোমবলি হিসেবে যিহোবার কাছে উৎসর্গ করেছিলেন। (আদিপুস্তক ৭:২; ৮:২০) এই উপাসনা কি যিহোবাকে সন্তুষ্ট করেছিল?

বাইবেল এই আশ্বাসদায়ক কথার দ্বারা এর উত্তর দেয়: “সদাপ্রভু তাহার সৌরভ আঘ্রাণ করিলেন।” মানবজাতি পৃথিবীকে দৌরাত্ম্যে ভরিয়ে দেওয়ায় ঈশ্বর যে-দুঃখ পেয়েছিলেন, সেটার পরিবর্তে তাঁর হৃদয় এই সৌরভ বা সুগন্ধে, মনোরম অনুভূতিতে ভরে গিয়েছিল, যখন তিনি পৃথিবীতে এই বিশ্বস্ত উপাসকদের পরিবারকে দেখেছিলেন, যারা তাঁর ইচ্ছা পালন করার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিল। যিহোবা তাদের কাছ থেকে সিদ্ধতা আশা করেননি। সেই একই পদ আমাদের জানায়: “বাল্যকাল অবধি মনুষ্যের মনস্কল্পনা দুষ্ট।” (আদিপুস্তক ৮:২১) বিবেচনা করে দেখুন, যিহোবা কীভাবে এর পরেও মানবজাতির প্রতি তাঁর ধৈর্যপূর্বক সমবেদনা দেখিয়ে চলেছিলেন।

ঈশ্বর ভূমির ওপর যে-অভিশাপ দিয়েছিলেন, তা তুলে নিয়েছিলেন। আদম ও হবা যখন বিদ্রোহ করেছিল, তখন ঈশ্বর এই অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, ভূমিতে ফসল ফলানো খুবই কষ্টকর হবে। নোহের পিতা লেমক তার ছেলের নাম রেখেছিলেন নোহ, সম্ভবত যেটার অর্থ ছিল “বিশ্রাম” আর তিনি ভবিষ্যদ্‌বাণী করেছিলেন, তার ছেলে মানবজাতিকে সেই অভিশাপ থেকে বিশ্রাম বা রেহাই পাওয়ার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবেন। নোহ এটা উপলব্ধি করতে পেরে নিশ্চয় খুবই খুশি হয়েছিলেন যে, তিনি এখন সেই ভবিষ্যদ্‌বাণীর পরিপূর্ণতা দেখতে পাবেন আর তারা সহজেই ভূমিতে ফসল ফলাতে পারবে। তাই এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, নোহ খুব তাড়াতাড়ি চাষবাসের কাজ শুরু করেছিলেন।—আদিপুস্তক ৩:১৭, ১৮; ৫:২৮, ২৯; ৯:২০.

সেই একই সময়ে, যিহোবা নোহের সমস্ত বংশধরকে তাদের জীবন পরিচালনা করার জন্য নরহত্যা ও রক্তের অপব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা-সহ কিছু স্পষ্ট ও সরল নিয়ম দিয়েছিলেন। এ ছাড়া, ঈশ্বর এই প্রতিজ্ঞা করে মানবজাতির সঙ্গে একটা চুক্তি করেছিলেন যে, তিনি আর কখনো পৃথিবীর মধ্যে জীবিত সমস্তকিছুকে জল দ্বারা বিনষ্ট করবেন না। যিহোবা যে তাঁর প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করবেন, সেটার প্রমাণ হিসেবে তিনি প্রথম বার এক অপূর্ব প্রাকৃতিক বিষয়, একটা মেঘধনুর ঝলক দেখিয়েছিলেন। সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত, আমরা যত বার কোনো মেঘধনু দেখি, তত বার তা আমাদেরকে যিহোবার সেই সান্ত্বনাদায়ক প্রেমময় প্রতিজ্ঞা সম্বন্ধে মনে করিয়ে দেয়।—আদিপুস্তক ৯:১-১৭.

নোহের ঘটনাটা যদি শুধুমাত্র এক অলীক কাহিনি হতো, তাহলে তা মেঘধনু দেখার পরেই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু, নোহ একজন বাস্তব ব্যক্তি ছিলেন আর তার জীবন এতটা সহজসরল ছিল না। সেই সময়ে যখন লোকেরা অনেক দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকত, তখন এই বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে আরও ৩৫০ বছরের জীবনকাল অতিবাহিত করতে হয়েছিল আর সেই সময়কাল তার জন্য অনেক কষ্ট নিয়ে এসেছিল। তিনি একটা বড়ো ভুল করে ফেলেছিলেন, যখন একবার তিনি দ্রাক্ষারস পান করে মত্ত হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু সেই ভুল ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছিল, যখন তার নাতি কনান তার চেয়েও গুরুতর এক পাপ করেছিলেন, যা কনানের পরিবারের ওপর ভয়ানক পরিণতি নিয়ে এসেছিল। নোহ সেইসময় পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন, যখন তার বংশধরেরা নিম্রোদের সময়ে প্রতিমাপূজা এবং দৌরাত্ম্যের মতো পাপে পতিত হয়েছিল। অবশ্য অন্যদিকে, নোহ তার ছেলে শেমকে তার পরিবারের জন্য বিশ্বাসের এক দৃঢ় উদাহরণ স্থাপন করতে দেখেছিলেন।—আদিপুস্তক ৯:২১-২৮; ১০:৮-১১; ১১:১-১১.

নোহের মতো আমাদেরও বিভিন্ন সমস্যা সত্ত্বেও বিশ্বস্ত থাকতে হবে। আমাদের চারপাশে অন্যেরা যখন সত্য ঈশ্বরকে উপেক্ষা করে, কিংবা তাঁকে উপাসনা করা বন্ধ করে দেয়, তখনও আমাদের নোহের মতো বিশ্বস্ত থাকতে হবে। এইরকম বিশ্বস্ততার সঙ্গে ধৈর্য ধরাকে যিহোবা উচ্চমূল্য দিয়ে থাকেন। যিশু খ্রিস্ট যেমন বলেছিলেন, “যে কেহ শেষ পর্য্যন্ত স্থির থাকিবে, সেই পরিত্রাণ পাইবে।”—মথি ২৪:১৩. ▪ (w১৩-E ০৮/০১)

[পাদটীকাগুলো]

a কেউ কেউ মনে করে যে, ঈশ্বর সেই পশুদের আপেক্ষিকভাবে এক নিষ্ক্রিয় অবস্থায়, এক প্রকারের শীতঘুম অবস্থায় রেখেছিলেন, যাতে তাদের কম পরিমাণ খাদ্যের প্রয়োজন হয়। ঈশ্বর তা করে থাকুন বা না-ই থাকুন, তিনি জাহাজের সকলের সুরক্ষা করার বিষয়ে যে-প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তা নিশ্চিতভাবেই পূরণ করেছিলেন।

b এমনটা হতে পারে যে, এদন উদ্যানের সমস্ত চিহ্নও সেই জলপ্লাবনে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে যে-করূবেরা উদ্যানের প্রবেশপথ পাহারা দিচ্ছিল, তারাও তাদের ১৬০০ বছরের কার্যভার সমাপ্ত করে, শেষপর্যন্ত স্বর্গে ফিরে যেতে পেরেছিল।—আদিপুস্তক ৩:২২-২৪.

[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]

[১১ পৃষ্ঠার চিত্র]

কোনো সন্দেহ নেই, সেই কঠিন সময়েও নোহ পারিবারিক উপাসনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন

[১৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

নোহ ও তার পরিবার জাহাজ থেকে বের হয়ে এক পরিষ্কার পৃথিবীতে পা রেখেছিল