সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

“সদাপ্রভু আমার বল”

“সদাপ্রভু আমার বল”

“সদাপ্রভু আমার বল”

বলেছেন জোন কোভিল

১৯২৫ সালের জুলাই মাসে ইংল্যান্ডের হাডার্সফিল্ডে আমি জন্মগ্রহণ করি। আমি একমাত্র সন্তান ছিলাম আর আমার স্বাস্থ্য দুর্বল ছিল। বস্তুতপক্ষে, আমার বাবা বলতেন, “একটু হাওয়া-বাতাস লাগলেই তুই অসুস্থ হয়ে পড়িস।” আর মনে হয় সত্যিই তা হতো!

 আমি যখন ছোটো ছিলাম, তখন পাদরিরা শান্তির জন্য ঐকান্তিকভাবে প্রার্থনা করেছিল কিন্তু যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তখন তারা জয়লাভের জন্য প্রার্থনা করেছিল। এই বিষয়টা আমাকে বিভ্রান্ত করেছিল ও আমার মনে সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছিল। সেই সময়ে, আমাদের এলাকায় বসবাসরত একমাত্র সাক্ষি অ্যানি রেটক্লিফ আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন।

সত্যের সংস্পর্শে আসা

অ্যানি আমাদেরকে পরিত্রাণ (ইংরেজি) নামক বইটি দিয়ে গিয়েছিলেন এবং বাইবেল সম্বন্ধীয় একটা আলোচনায় যোগদান করার জন্য আমার মাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, যেটা অ্যানির বাড়িতে অনুষ্ঠিত হবে। * মা আমাকে তার সঙ্গে যেতে বলেছিলেন। সেই প্রথম আলোচনার বিষয়টা আমার এখনও মনে আছে। এটা ছিল মুক্তির মূল্য সম্বন্ধীয় আলোচনা আর আশ্চর্যের বিষয় যে, সেই আলোচনা আমার একেবারেই একঘেয়ে লাগেনি। এই আলোচনা আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল। পরের সপ্তাহে আমরা আবারও যোগদান করেছিলাম। সেই সময়, শেষকালের চিহ্ন সম্বন্ধে যিশুর দেওয়া ভবিষ্যদ্বাণী ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। জগতের খারাপ পরিস্থিতি দেখে মা ও আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম যে, এটাই সত্য। সেই একই দিনে, আমাদেরকে কিংডম হলে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।

সেই কিংডম হলে কিছু অল্পবয়সি অগ্রগামীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল আর তাদের মধ্যে ছিলেন জইস বারবার (এখন ইলাস), যিনি তার স্বামী পিটারের সঙ্গে এখনও লন্ডন বেথেলে সেবা করছেন। আমি মনে করেছিলাম যে, অগ্রগামীর কাজটা প্রত্যেকেই করে। তাই, তখন থেকেই আমি প্রত্যেক মাসে ৬০ ঘন্টা করে প্রচার করা শুরু করি, এমনকি যদিও আমি তখনও স্কুলে যেতাম।

পাঁচ মাস পর, ১৯৪০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, আমার মা ও আমি ব্র্যাডফোর্ডে একটা জোন অ্যাসেম্বলিতে (এখন সীমা সম্মেলন বলা হয়) বাপ্তিস্ম নিই। যদিও বাবা আমাদের নতুন ধর্মের বিরোধিতা করেননি কিন্তু তিনি কখনো সত্যের পক্ষে পদক্ষেপ নেননি। যে-সময়ে আমি বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম, সেই সময়ে রাস্তার কোণে সাক্ষ্যদান করা চালু হয়েছিল। আমি পত্রিকার একটা ব্যাগ ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে তাতে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এক শনিবারে, আমাকে একটা শপিং এলাকার সবচেয়ে ব্যস্ততম জায়গায় দাঁড়াতে বলা হয়েছিল। তখনও আমার লোকভয় ছিল আর আমি যে-ভয় করেছিলাম, ঠিক সেটাই হয়েছিল, মনে হয়েছিল যেন রাস্তার যে-কোণে আমি দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান দিয়েই আমার সমস্ত সহপাঠী গিয়েছিল!

আমরা যে-কোম্পানির (তখন মণ্ডলীকে যে-নামে ডাকা হতো) অধীনে ছিলাম, সেটাকে ১৯৪০ সালে বিভক্ত করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। বিভক্ত করার পর, আমার সমবয়সি প্রায় সবাই অন্য কোম্পানিতে চলে গিয়েছিল। আমি কোম্পানি দাসের (এখন পরিচারক অধ্যক্ষ বলা হয়) কাছে এই বিষয়টা সম্বন্ধে অভিযাগ করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, “তুমি যদি অল্পবয়সি সঙ্গীদের পেতে চাও, তাহলে প্রচার করে তাদেরকে খুঁজে নাও।” আর আমি ঠিক সেটাই করেছিলাম! খুব শীঘ্রই, এলসি নোবেলের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। সে সত্য গ্রহণ করেছিল আর তারপর আমার আজীবন বন্ধু হয়েছিল।

অগ্রগামীর কাজ ও সেই কাজের আশীর্বাদগুলো

স্কুলের পড়া শেষ করার পর, আমি একজন হিসাবরক্ষকের অধীনে কাজ করি। কিন্তু, যখন আমি পূর্ণসময়ের দাসদের আনন্দ লক্ষ করি, তখন একজন অগ্রগামী হিসেবে যিহোবাকে সেবা করার বিষয়ে আমার ইচ্ছা বৃদ্ধি পায়। ১৯৪৫ সালের মে মাসে, একজন বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে কাজ শুরু করার আনন্দ আমি লাভ করেছিলাম। আমার অগ্রগামী কাজের প্রথম দিন, সারাদিন ধরে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছিল। তবুও, প্রচার কাজে বের হয়ে আমি এতই আনন্দিত হয়েছিলাম যে, বৃষ্টি আমাকে নিরুৎসাহিত করতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে, প্রতিদিন বাইরে থাকা ও পরিচর্যায় নিয়মিত সাইকেল চালিয়ে যাওয়া আমার স্বাস্থ্যের ওপর ভাল প্রভাব ফেলেছিল। যদিও আমার ওজন কখনো ৪২ কেজির বেশি বাড়েনি, তবুও আমার অগ্রগামীর কাজে তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বছরের পর বছর ধরে, আমি একেবারে আক্ষরিকভাবে এই অভিজ্ঞতা লাভ করেছি যে, “সদাপ্রভু আমার বল।”—গীত. ২৮:৭.

নতুন নতুন মণ্ডলী গঠন করার লক্ষ্য নিয়ে আমাকে একজন বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেই শহরগুলোতে পাঠানো হয়েছিল, যেখানে কোনো সাক্ষি ছিল না। প্রথম তিন বছর আমি ইংল্যান্ডে আর তার পরের তিন বছর আয়ার্ল্যান্ডে সেবা করি। আয়ার্ল্যান্ডের লিসবার্নে অগ্রগামীর কাজ করার সময়, আমি এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে অধ্যয়ন করেছিলাম, যিনি এক প্রটেস্টান্ট গির্জার একজন সহযোগী পাস্টর ছিলেন। বাইবেলের মৌলিক মতবাদগুলো সম্বন্ধে সত্য শেখার সঙ্গেসঙ্গে, তিনি তার নতুন অর্জিত জ্ঞান সম্বন্ধে তার মণ্ডলীতে শিক্ষা দিতে থাকেন। মণ্ডলীর কিছু সদস্য গির্জার কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করে আর স্বাভাবিকভাবেই কেন তিনি এই ধরনের মতবাদ সম্বন্ধে শিক্ষা দিচ্ছেন, সেই সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করতে বলা হয়। তিনি বলেছিলেন, তার পালকে যে তিনি অনেক মিথ্যা শিক্ষা দিয়েছেন, সেই বিষয়টা তাদের কাছে বলাকে তিনি তার খ্রিস্টীয় দায়িত্ব বলে মনে করেন। যদিও তার পরিবার প্রচণ্ডভাবে তার বিরোধিতা করেছিল, তবুও তিনি যিহোবার কাছে তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত বিশ্বস্তভাবে তাঁর সেবা করে গিয়েছিলেন।

আয়ার্ল্যান্ডে আমার দ্বিতীয় অগ্রগামীর কার্যভারে থাকাকালীন আমি একা একা লার্নে ছয় সপ্তাহ সেবা করেছিলাম, কারণ আমার অগ্রগামী সঙ্গী ১৯৫০ সালে নিউ ইয়র্কে ঈশতন্ত্রের বৃদ্ধি সম্মেলনে যোগদান করার জন্য গিয়েছিলেন। আমার জন্য সেই সময়টা খুবই কঠিন ছিল। আমি সেই সম্মেলনে খুবই যেতে চেয়েছিলাম। যাই হোক, সেই সপ্তাহগুলোতে আমি ক্ষেত্রের পরিচর্যায় বেশ কয়েকটা উৎসাহজনক অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলাম। একজন বয়স্ক লোকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল, যিনি ২০ বছরেরও বেশি সময় আগে আমাদের একটি প্রকাশনা নিয়েছিলেন। বছরের পর বছর ধরে, তিনি এত বার এটি পড়েছিলেন যে, তিনি সেটিকে প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। তিনি তার ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে একত্রে সত্য গ্রহণ করেছিলেন।

গিলিয়েড স্কুল-এ প্রশিক্ষণ লাভ করা

১৯৫১ সালে, ইংল্যান্ড থেকে আসা অন্য দশজন অগ্রগামীর সঙ্গে, আমাকে নিউ ইয়র্কের সাউথ ল্যানসিংয়ে ১৭তম গিলিয়েড স্কুল-এ যোগদান করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই মাসগুলোতে আমরা বাইবেল থেকে যে-শিক্ষা লাভ করেছিলাম, তা আমি কতই না উপভোগ করেছিলাম! সেই সময়ে, বোনেরা স্থানীয় মণ্ডলীগুলোতে ঐশিক পরিচর্যা বিদ্যালয়-এ বক্তৃতা দিতে পারত না কিন্তু গিলিয়েড-এ আমরা বোনেরা ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত বক্তৃতা দেওয়ার ও রিপোর্ট পেশ করার কার্যভার পেয়েছিলাম। আমরা খুবই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম! আমার প্রথম বক্তৃতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, নোট ধরে থাকা অবস্থায় আমার হাত দুটো কাঁপছিল। নির্দেশক, ভাই ম্যাক্সওয়েল ফ্রেন্ড মজা করে বলেছিলেন: “সমস্ত উত্তম বক্তার মতো, আপনি কেবল শুরুতেই নয় কিন্তু একেবারে শেষ পর্যন্ত ঘাবড়ানো অবস্থায় ছিলেন।” কোর্স চলাকালীন, আমরা সকলেই ক্লাসের সামনে নিজেদেরকে প্রকাশ করার দক্ষতাকে উন্নত করেছিলাম। খুব শীঘ্রই, আমাদের প্রশিক্ষণ শেষ হয়ে গিয়েছিল আর আমরা গ্র্যাজুয়েটরা কয়েকটা দেশে কার্যভার পেয়েছিলাম। আমাকে থাইল্যান্ডে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল!

“সদা হাস্যময়ী দেশ”

থাইল্যান্ডে আমার মিশনারি সঙ্গী হওয়ার জন্য অ্যাসট্রিড অ্যান্ডারসনকে নিযুক্ত করাকে আমি যিহোবার কাছ থেকে প্রাপ্ত এক দান বলে মনে করি। মালবাহী এক জাহাজে করে সেখানে যেতে আমাদের সাত সপ্তাহ লেগে গিয়েছিল। আমরা যখন রাজধানী ব্যাংককে পৌঁছেছিলাম, তখন আমরা কর্মব্যস্ত অনেক বাজার ও শহরের প্রধান রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত পরস্পর সংযুক্ত খাল সম্বলিত একটা শহর দেখতে পেয়েছিলাম। ১৯৫২ সালে, থাইল্যান্ডে ১৫০ জনেরও কম রাজ্য প্রকাশক ছিল।

আমরা যখন প্রথম থাই ভাষার প্রহরীদুর্গ পত্রিকাটি দেখেছিলাম, তখন আমরা ভেবেছিলাম যে, ‘আমরা কি কখনো সেই ভাষায় কথা বলতে পারব?’ বিশেষভাবে শব্দগুলোকে সঠিক স্বরভঙ্গিতে উচ্চারণ করা কঠিন ছিল। উদাহরণস্বরূপ, কাঅয়ু শব্দটি চড়া স্বরে শুরু হয়ে নিচু স্বরে শেষ হলে সেটার অর্থ বোঝায় “ভাত” কিন্তু সেই একই শব্দ ভারি স্বরে বলা হলে সেটার অর্থ বোঝায় “সংবাদ।” তাই আমরা যখন ক্ষেত্রের পরিচর্যায় যেতাম, তখন প্রথম প্রথম আমরা লোকেরদেরকে “সুসমাচার” নিয়ে এসেছি একথা বলার পরিবর্তে, “আমি আপনার জন্য ভাত নিয়ে এসেছি,” একথা বলতে অভ্যস্ত ছিলাম! কিন্তু ধীরে ধীরে—এবং অনেক হাসিঠাট্টার পর—আমরা সঠিকটা বলতে শিখেছিলাম।

থাই লোকেরা খুবই বন্ধুত্বপরায়ণ। তাই উপযুক্তভাবেই, থাইল্যান্ডকে সদা হাস্যময়ী দেশ বলা হয়। আমাদের প্রথম কার্যভার ছিল কোরাট শহরে (বর্তমানে যেটাকে নাকন রাচেসিমা বলা হয়), যেখানে আমরা দুবছর ধরে সেবা করেছিলাম। পরে আমাদেরকে চিয়াং মাই শহরে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। অধিকাংশ থাই লোকেরা হল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী আর তারা বাইবেলের সঙ্গে পরিচিত নয়। কোরাটে আমি একজন পোস্টমাস্টারের সঙ্গে অধ্যয়ন করেছিলাম। আমরা কুলপতি অব্রাহাম সম্বন্ধে আলোচনা করেছিলাম। যেহেতু সেই ব্যক্তি আগেই অব্রাহামের নাম শুনেছিলেন, তাই তিনি উৎসাহের সঙ্গে মাথা নাড়িয়েছিলেন। কিন্তু শীঘ্রই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমরা একই অব্রাহাম সম্বন্ধে কথা বলছিলাম না। পোস্টমাস্টারের মনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি অব্রাহাম লিংকনের কথা ছিল!

আমরা সৎহৃদয়ের থাই লোকেদেরকে বাইবেল সম্বন্ধে শিক্ষা দেওয়া উপভোগ করেছিলাম, কিন্তু একই সময়ে থাই লোকেরা আমাদেরকে শিখিয়েছিল যে, কীভাবে সাধাসিধে জীবনযাপন করে সুখী হওয়া যায়। সেই শিক্ষা মূল্যবান ছিল, কারণ কোরাটে প্রথম যে-মিশনারি হোমে আমরা ছিলাম, সেখানে বিদ্যুৎ অথবা জল সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল না। এই ধরনের কার্যভারগুলোতে আমরা “উপচয় কি অনাটন ভোগ করিতে দীক্ষিত হইয়াছি।” প্রেরিত পৌলের মতো, আমরাও ‘যিনি শক্তি দেন, তাঁহাতে সকলই করিতে পারি’ বলতে যা বোঝায়, তার অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলাম।—ফিলি. ৪:১২, ১৩.

একজন নতুন সঙ্গী ও এক নতুন কার্যভার

১৯৪৫ সালে আমি লন্ডন গিয়েছিলাম। সেই সময়ে, আমি কয়েক জন অগ্রগামী ও বেথেল কর্মীর সঙ্গে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গিয়েছিলাম। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন অ্যালেন কোভিল, যিনি এর অল্প কিছুদিন পরেই গিলিয়েড-এর ১১তম ক্লাসে যোগদান করেছিলেন। তাকে প্রথমে ফ্রান্সে ও পরে বেলজিয়ামে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। * পরে, আমি যখন থাইল্যান্ডে একজন মিশনারি হিসেবে সেবা করছিলাম, তখন তিনি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন আর আমি তাতে রাজি হয়েছিলাম।

১৯৫৫ সালের ৯ জুলাই, বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে আমাদের বিয়ে হয়েছিল। আমি সবসময়ই স্বপ্ন দেখতাম যে, প্যারিসে মধুচন্দ্রিমা যাপন করতে যাব, তাই অ্যালেন আমাদের জন্য পরের সপ্তাহে সেখানে একটা সম্মেলনে যোগদান করার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু সেখানে পৌঁছানো মাত্রই, অ্যালেনকে পুরো সম্মেলনে একজন অনুবাদক হিসেবে সাহায্য করতে বলা হয়েছিল। প্রতিদিন তাকে খুব সকালে যেতে হতো আর আমরা অনেক রাতে আমাদের থাকার জায়গায় ফিরতাম। তাই আমি প্যারিসে আমার মধুচন্দ্রিমা যাপন করেছিলাম বটে কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই অ্যালেনকে দূর থেকে অর্থাৎ মঞ্চ থেকে দেখেছিলাম! তা সত্ত্বেও, আমি আমার সদ্য বিবাহিত স্বামীকে তার ভাইবোনদের সেবা করার জন্য ব্যবহৃত হতে দেখে আনন্দিত হয়েছিলাম আর আমার মনে এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না যে, যিহোবা যদি আমাদের বিবাহের কেন্দ্রস্থলে থাকেন, তাহলে আমরা সত্যিই সুখী হব।

এ ছাড়া, বিয়ের ফলে আমাকে প্রচারের এক নতুন এলাকায়—বেলজিয়ামে—যেতে হয়েছিল। বেলজিয়াম সম্বন্ধে আমার মোটামুটি যে-ধারণা ছিল তা হল যে, এই দেশটা বেশ কয়েকটা যুদ্ধে এক যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে কিন্তু শীঘ্রই আমি জানতে পেরেছিলাম যে, বেলজিয়ামের অধিকাংশ লোক সত্যিই শান্তিপ্রিয়। এ ছাড়া, আমার কার্যভারের অর্থ এও ছিল যে, আমাকে ফ্রেঞ্চ ভাষা শিখতে হবে, যে-ভাষাটা দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে বলা হয়।

১৯৫৫ সালে, বেলজিয়ামে প্রায় ৪,৫০০ জন প্রকাশক ছিল। প্রায় ৫০ বছর ধরে, অ্যালেন ও আমি বেথেল সেবা এবং ভ্রমণ অধ্যক্ষের কাজ করেছি। প্রথম আড়াই বছর, রোদ-বৃষ্টি যা-ই হোক না কেন, আমরা সাইকেলে করে পাহাড়ের ওপরে-নীচে সর্বত্র ভ্রমণ করেছি। বছরের পর বছর ধরে, আমরা ২,০০০রেরও বেশি সহসাক্ষিদের বাড়িতে রাত কাটিয়েছি! প্রায়ই এমন ভাইবোনদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হতো, যারা শারীরিকভাবে দুর্বল অথচ তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে তারা যিহোবার সেবা করেছে। তাদের উদাহরণ আমাকে আমার পরিচর্যায় হাল ছেড়ে না দিতে উৎসাহিত করেছে। প্রতি সপ্তাহে একটা মণ্ডলী পরিদর্শন শেষ করার পর, আমরা সবসময়ই উৎসাহিত বোধ করতাম। (রোমীয় ১:১১, ১২) অ্যালেন আমার সত্যিকারের একজন সঙ্গী ছিল। উপদেশক ৪:৯, ১০ পদের এই কথাগুলো কতই না সত্য: “এক জন অপেক্ষা দুই জন ভাল, . . . কারণ তাহারা পড়িলে এক জন আপন সঙ্গীকে উঠাইতে পারে”!

‘সদাপ্রভুর বলে’ সেবা করার এক জীবন থেকে আশীর্বাদ

বছরের পর বছর ধরে, অ্যালেন ও আমি যিহোবাকে সেবা করার জন্য অন্যদেরকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে অনেক আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮৩ সালে আমরা অ্যান্টওয়ার্পের ফ্রেঞ্চ মণ্ডলী পরিদর্শন করেছিলাম, যেখানে আমরা এমন একটা পরিবারের সঙ্গে ছিলাম, যারা জাইরে (বর্তমানে কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র) থেকে আসা বেঞ্জামিন ব্যান্ডিভিলা নামে একজন যুবক ভাইকেও তাদের বাড়িতে থাকতে দিয়েছিল। বেঞ্জামিন উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্য বেলজিয়ামে এসেছিলেন। তিনি আমাদের বলেছিলেন, “যিহোবার সেবায় সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গীকৃত আপনাদের জীবনটা দেখে সত্যিই আমার ঈর্ষা হয়।” অ্যালেন উত্তর দিয়েছিল: “আপনি বললেন যে, আমাদের দেখে আপনার ঈর্ষা হয়; অথচ আপনি জাগতিক কেরিয়ারের পিছনে ছুটছেন। আপনার কি মনে হয় না যে, এটা পরস্পরবিরোধী?” সেই স্পষ্ট মন্তব্য বেঞ্জামিনকে তার জীবন নিয়ে চিন্তা করতে পরিচালিত করেছিল। পরে জাইরে ফিরে গিয়ে তিনি অগ্রগামীর কাজ শুরু করেছিলেন এবং বর্তমানে তিনি শাখা কমিটির একজন সদস্য হিসেবে সেবা করছেন।

১৯৯৯ সালে, আমার খাদ্যনালি থেকে আলসার কেটে বাদ দেওয়ার জন্য অপারেশন করতে হয়েছিল। তখন থেকেই, আমার ওজন মাত্র ৩০ কেজি। আমি সত্যিই এক ভঙ্গুর ‘মৃন্ময় পাত্র।’ কিন্তু আমি কৃতজ্ঞ যে, যিহোবা আমাকে “পরাক্রমের উৎকর্ষ” দিয়েছেন। আমার অপারেশনের পর, তিনি আমাকে আবারও অ্যালেনের সঙ্গী হয়ে তার সঙ্গে ভ্রমণ কাজে যাওয়া সম্ভবপর করেছিলেন। (২ করি. ৪:৭) এরপর ২০০৪ সালের মার্চ মাসে, অ্যালেন ঘুমন্ত অবস্থায় মারা গিয়েছিল। যদিও আমি প্রচণ্ডভাবে তার অভাব বোধ করি কিন্তু এটা জানা আমাকে সান্ত্বনা দেয় যে, সে যিহোবার স্মৃতিতে রয়েছে।

বর্তমানে ৮৩ বছর বয়সে, আমি পূর্ণসময়ের পরিচর্যায় ৬৩ বছরেরও বেশি সময় ব্যয় করার কথা চিন্তা করি। আমি এখনও পরিচর্যায় সক্রিয় আছি, বাড়িতে একটা বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করি এবং যিহোবার চমৎকার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কথা বলার জন্য রোজকার সুযোগগুলোকে ব্যবহার করি। মাঝে মাঝে আমি চিন্তা করি যে, ‘১৯৪৫ সালে আমি যদি অগ্রগামীর কাজ শুরু না করতাম, তাহলে আমার জীবন কেমন হতো?’ সেই সময়ে, আমার দুর্বল স্বাস্থ্য তা না করার যুক্তিযুক্ত কারণ বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু আমি কতই না কৃতজ্ঞ যে, আমি অল্পবয়সেই অগ্রগামীর কাজ গ্রহণ করেছিলাম! ব্যক্তিগতভাবে আমার এই অভিজ্ঞতা লাভ করার সুযোগ হয়েছিল যে, আমরা যদি যিহোবাকে প্রথম স্থান দিই, তাহলে তিনি আমাদের বল হবেন।

[পাদটীকাগুলো]

^ পরিত্রাণ বইটি ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এখন আর এটি ছাপানো হয় না।

^ ভাই কোভিলের জীবনকাহিনি ১৯৬১ সালের ১৫ মার্চ প্রহরীদুর্গ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

[১৮ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমার মিশনারি সঙ্গী, অ্যাসট্রিড অ্যান্ডারসনের সঙ্গে (ডান দিকে)

[১৮ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৫৬ সালে আমার স্বামীর সঙ্গে ভ্রমণের কাজে

[২০ পৃষ্ঠার চিত্র]

২০০০ সালে অ্যালেনের সঙ্গে