সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক সাক্ষাতের জন্য সময় নির্ধারণ করে রাখা

খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক সাক্ষাতের জন্য সময় নির্ধারণ করে রাখা

খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক সাক্ষাতের জন্য সময় নির্ধারণ করে রাখা

 আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক সাক্ষাতের জন্য সময় নির্ধারণ করে রেখেছি। কোন বিষয়টা আমাকে অর্থাৎ একজন যুবতী স্প্যানিশ মাকে সেই সাক্ষাতের জন্য সময় নির্ধারণ করে রাখতে পরিচালিত করেছিল, তা আপনাদের বলছি।

আমার বাবামার সংসারে শান্তি ও একতা ছিল না। চার বছর বয়সে একটা মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আমার ছোটো ভাই যখন মারা যায়, তখন আমাদের পরিবার অত্যন্ত শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অধিকন্তু, আমার বাবার বদভ্যাসগুলোর কারণে আমার মা তার বিবাহিত জীবনে তেমন সুখী ছিলেন না। কিন্তু সেই সমস্যা, আমার দাদা ও আমার মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধগুলো গেঁথে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাকে বাধা দেয়নি।

পরবর্তী সময়ে, আমার দাদা বিয়ে করেন এবং আমিও বিয়ে করি। এর অল্পসময় পরই আমার মার ক্যান্সার ধরা পড়ে, যার ফলে শেষপর্যন্ত তিনি মারা যান। কিন্তু, মারা যাওয়ার আগে তিনি আমাদের কাছে এক ধন হস্তান্তর করে যান।

তার পরিচিত একজন মহিলা তার কাছে পুনরুত্থানের শাস্ত্রীয় আশা সম্বন্ধে বলেছিলেন আর আমার মা বাইবেল অধ্যয়নের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। তার জীবনের শেষ সময়ে, বাইবেলের আশার বার্তা তাকে জীবনের অর্থ প্রদান করেছিল এবং সুখ খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিল।

আমরা যখন তার ওপর বাইবেলের বার্তার এক ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ করেছিলাম, তখন আমার দাদা আর আমিও ঈশ্বরের বাক্য অধ্যয়ন করতে শুরু করি। আমার দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের এক মাস আগে আমি একজন যিহোবার সাক্ষি হিসেবে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম আর আমরা আমাদের সেই সুন্দর মেয়েটার নাম রেখেছিলাম লুসিয়া।

আমার বাপ্তিস্মের দিনটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এর একটা কারণ ছিল যে, তখন থেকে আমি যিহোবার অধিকারভুক্ত হয়ে গিয়েছি, চিরকাল তাঁর সেবা করার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছি। আরেকটা কারণ ছিল, আমি আমার প্রিয় ছেলে ও মেয়েকে আমার বিশ্বাস সম্বন্ধে জানাতে পারব।

কিন্তু, আমার আনন্দের দ্বিতীয় কারণটা শীঘ্রই বিঘ্নিত হয়। চার বছর বয়সে লুসিয়া প্রচণ্ড পেটের ব্যথায় ভুগতে থাকে। অনেকগুলো পরীক্ষা করার পর, রেডিওলজিস্ট ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, তার যকৃতের (লিভারের) সঙ্গে কমলালেবুর আকারের একটা টিউমার যুক্ত রয়েছে। ডাক্তার ব্যাখ্যা করেছিলেন, লুসিয়ার নিউরোব্ল্যাস্টোমা রয়েছে, যেটা হল এমন এক টিউমার, যা দ্রুত বড় হয় ও ক্যান্সারের দিকে মোড় নেয়। এভাবেই ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লুসিয়ার সাত বছরের সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল বেশ কয়েক বার দীর্ঘসময়ের জন্য হাসপাতালে থাকা।

এক আত্মত্যাগমূলক মনোভাব

এই কষ্টকর বছরগুলোতে লুসিয়া প্রায়ই আমাকে উষ্ণভাবে জড়িয়ে ধরে ও আশ্বাসদায়ক চুমু খেয়ে উৎসাহিত করত। সে যতটা শান্তভাবে তার রোগের যন্ত্রণা সহ্য করেছে, তা হাসপাতালের কর্মীদের ওপরও ছাপ ফেলেছিল। সে সবসময় নার্সদের সাহায্য করার জন্য উৎসুক ছিল, হাসপাতালে ভরতি আশেপাশের ওয়ার্ডের বাচ্চাদের দই, জুস ও অন্যান্য সামগ্রী বিতরণ করায় নার্সদের সাহায্য করত। এমনকি নার্সরা লুসিয়াকে একটা সাদা কোট ও “নার্সের সহকারী” হিসেবে শনাক্তকারী একটা ব্যাজ কার্ডও দিয়েছিল।

“লুসিয়া আমার হৃদয়কে নাড়া দিয়েছিল,” হাসপাতালের একজন কর্মী স্মরণ করে বলেন। “সে ছিল এক চটপটে, সৃজনশীল শিশু আর সে ছবি আঁকতে ভালবাসত। সে ছিল প্রাণবন্ত ও পরিপক্ব এক মেয়ে, সে বড়দের মতোই সবকিছু বুঝতে পারত।”

লুসিয়া ঈশ্বরের বাক্য থেকে শক্তি ও শান্তভাব লাভ করেছিল। (ইব্রীয় ৪:১২) তার এই দৃঢ়প্রত্যয় ছিল যে, নতুন জগতে “মৃত্যু আর হইবে না; শোক বা আর্ত্তনাদ বা ব্যথাও আর হইবে না,” যেমনটা ঈশ্বরের বাক্য প্রতিজ্ঞা করে। (প্রকা. ২১:৪) অন্যদের প্রতি আগ্রহ থাকায় সে বাইবেলের বার্তা জানানোর জন্য প্রতিটা সুযোগকে কাজে লাগাত। পুনরুত্থানে লুসিয়ার দৃঢ় আশা তাকে আত্মসংবরণ করতে এবং তার সুস্থ হওয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, হাসিখুশিভাব বজায় রাখতে সাহায্য করেছিল। (যিশা. ২৫:৮) ক্যান্সার তার জীবন কেড়ে নেওয়ার আগে পর্যন্ত সে সেই মনোভাব বজায় রেখেছিল।

সেদিনই আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেই সাক্ষাতের জন্য সময় নির্ধারণ করে রেখেছিলাম। লুসিয়া তার চোখ খুলতেই পারছিল না। তার বাবা তার একটা হাত ধরে রেখেছিল আর আমি আরেকটা হাত ধরে রেখেছিলাম। “চিন্তা কোরো না, আমি তোমাকে রেখে কোথাও যাব না,” আমি ফিসফিস করে বলেছিলাম। “শুধু ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নাও। তুমি যখন জেগে উঠবে, তখন তোমার ভাল লাগবে। তোমার আর কোনো ব্যথা থাকবে না আর আমি তোমার সঙ্গেই থাকব।”

এখন আমাকে সেই নির্ধারিত সাক্ষাতের কথা রাখতে হবে। আমি জানি যে, অপেক্ষার এই সময়কাল সহজ হবে না। কিন্তু আমি এও জানি যে, আমি যদি ধৈর্য সহকারে যিহোবার ওপর আস্থা রাখি এবং তাঁর প্রতি নীতিনিষ্ঠা বজায় রাখি, তাহলে লুসিয়া যখন পুনরুত্থানে ফিরে আসবে, তখন আমি সেখানে থাকতে পারব।

লুসিয়ার রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার

লুসিয়ার সাহসী উদাহরণ আর সেইসঙ্গে মণ্ডলীর চমৎকার সমর্থন আমার স্বামীর ওপর এক গভীর ছাপ ফেলেছিল, যে আমার বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিল না। লুসিয়া যেদিন মারা যায়, সেদিন সে আমাকে বলেছিল যে, তাকে তার চিন্তাভাবনা পুনর্বিবেচনা করে দেখতে হবে। কয়েক সপ্তাহ পর, সে মণ্ডলীর একজন প্রাচীনকে তাকে বাইবেল অধ্যয়ন করানোর জন্য অনুরোধ করেছিল। শীঘ্রই আমার স্বামী সবগুলো সভাতে যোগ দিতে শুরু করেছিল। যিহোবার সাহায্যে সে ধূমপান বন্ধ করতে পেরেছিল, যে-কাজটা সে আগে করতে পারেনি।

যদিও লুসিয়াকে হারানোর কষ্ট পুরোপুরি দূর হয়ে যায়নি কিন্তু লুসিয়া যে-উত্তরাধিকার রেখে গিয়েছে, সেটার জন্য আমি যিহোবার কাছে খুবই কৃতজ্ঞ। আমার স্বামী ও আমি পুনরুত্থানের চমৎকার আশার দ্বারা একে অপরকে সান্ত্বনা দিই, এমনকি সেই সময়ের কথা কল্পনা করি যখন আমরা আবারও লুসিয়াকে—তার প্রাণবন্ত বড় বড় চোখ এবং গালে টোল-পড়া হাসিসহ—দেখতে পাব।

আমার মেয়ের কষ্টকর অভিজ্ঞতা বিশেষভাবে একজন প্রতিবেশীকেও প্রভাবিত করেছিল। এক বর্ষণমুখর শনিবার সকালে, একজন মহিলা আমাদের ঘরে এসেছিলেন, যার ছেলে লুসিয়ার সঙ্গে একই স্কুলে পড়ত। তার আরেক ছেলে ১১ বছর বয়সে একই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে। তিনি যখন শুনেছিলেন যে লুসিয়ার কী হয়েছে, তখন আমরা কোথায় থাকি তা তিনি খুঁজে বের করেছিলেন এবং আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি জানতে চেয়েছিলেন যে, কীভাবে আমি লুসিয়ার মৃত্যুর কষ্ট সহ্য করছি আর প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, একই পরিস্থিতিতে থাকা অন্যান্য মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আমরা নিজেরা মিলে একটা দল গঠন করতে পারি।

আমি ব্যাখ্যা করেছিলাম যে, আমি ব্যক্তিগতভাবে বাইবেলের একটা প্রতিজ্ঞা থেকে প্রকৃত সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছি, যেটা মানুষের করা যেকোনো প্রতিজ্ঞার চেয়ে হাজার গুণ শ্রেষ্ঠ। আমি যখন তাকে যোহন ৫:২৮, ২৯ পদে লিপিবদ্ধ যিশুর কথাগুলো পড়ে শোনাই, তখন তার চোখ প্রত্যাশায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তিনি বাইবেল অধ্যয়নের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন এবং শীঘ্রই “সমস্ত চিন্তার অতীত যে ঈশ্বরের শান্তি, তাহা” অনুভব করতে শুরু করেছিলেন। (ফিলি. ৪:৭) একসঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করার সময় আমরা প্রায়ই একটু থামি এবং নিজেদেরকে নতুন জগতে কল্পনা করি, যেখানে আমরা পুনরুত্থানে ফিরে আসা আমাদের প্রিয়জনকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছি।

হ্যাঁ, লুসিয়ার সংক্ষিপ্ত জীবন এক দীর্ঘস্থায়ী উত্তরাধিকার রেখে গিয়েছে। তার বিশ্বাস আমাদের পরিবারকে যিহোবার সেবায় একতাবদ্ধ করেছে এবং এটা একইভাবে বিশ্বাসে অটল থাকার বিষয়ে আমার দৃঢ়সংকল্পকে বৃদ্ধি করেছে। কোনো সন্দেহ নেই যে, আমরা যারা এমন প্রিয়জনদের হারিয়েছি যারা হয়তো পুনরুত্থিত হতে পারে, আমরা সবাই তাদের সঙ্গে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক সাক্ষাতের জন্য সময় নির্ধারণ করে রেখেছি।

[২০ পৃষ্ঠার চিত্র]

লুসিয়ার আঁকা পরমদেশের ছবি