সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

ঈশ্বরের নতুন জগতের দিকে এগিয়ে চলা

ঈশ্বরের নতুন জগতের দিকে এগিয়ে চলা

জীবনকাহিনি

ঈশ্বরের নতুন জগতের দিকে এগিয়ে চলা

বলেছেন জ্যাক প্রামবারি

মধ্য সুইডেনে ছবির মতো একটা ছোট্ট শহর আরবুগার বাইরে, ৮০ জনেরও বেশি স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে যিহোবার সাক্ষিদের একটা শাখা অফিস রয়েছে। এখানেই আমার স্ত্রী কারিন এবং আমি থাকি ও কাজ করি। কীভাবে আমরা এখানে এসেছিলাম?

 ঊ নবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে, ১৫ বছর বয়সি একটা সুইডিশ মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়েছিল। নিউ ইয়র্ক সিটির একটা অভিবাসী শিবিরে একজন সুইডিশ নাবিকের সঙ্গে সেই মেয়েটির পরিচয় হয়। এই পরিচয় প্রণয় থেকে বিয়ের দিকে গড়ায় আর একটা ছেলে সন্তানের—আমার—জন্ম হয়। ১৯১৬ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ব্রন্‌স্কে আমার জন্ম হয়েছিল।

কিছুদিন পরেই, আমরা ব্রুকলিনে চলে এসেছিলাম, যেটা ব্রুকলিন হাইটস্‌ থেকে মাত্র কয়েক ব্লক দূরে ছিল। আমার বাবা পরে আমাকে বলেছিলেন যে, তিনি এবং আমি ব্রুকলিন ব্রিজের কাছে ছোটখাটো একটা জাহাজ চালিয়েছিলাম, যে-জায়গাটা যিহোবার সাক্ষিদের বিশ্ব প্রধান কার্যালয় থেকে সহজেই দেখা যেত। সেই সময় আমি বুঝতেই পারিনি যে, সেখানকার কাজকর্ম আমার জীবনকে এতটা প্রভাবিত করবে।

১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল এবং কিছু সময়ের জন্য ইউরোপে উদ্দেশ্যহীন গণহত্যা শেষ হয়েছিল। সৈন্যরা এক নতুন ধরনের শত্রুর—বেকারত্ব এবং দরিদ্রতার—মুখোমুখি হতে তাদের ঘরে ফিরে এসেছিল। আমার বাবা মনে করেছিলেন যে, সুইডেনে ফিরে যাওয়াটাই সবচেয়ে ভাল হবে আর ১৯২৩ সালে আমরা তা-ই করেছিলাম। আমরা শেষ পর্যন্ত ইরিকস্টাডে বসবাস করি, যেটা ছিল ডালসল্যান্ড এলাকায় একটা রেলওয়ে স্টেশনের কাছে ছোট্ট একটা গ্রাম। সেখানে আমার বাবা একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ চালু করেছিলেন আর সেখানেই আমি বড় হয়ে উঠেছিলাম এবং স্কুলে গিয়েছিলাম।

এক বীজ বপন করা হয়েছিল

আমার বাবার ব্যাবসা ভাল চলেনি। তাই, ১৯৩০ এর দশকের প্রথমদিকে তিনি আবার নাবিকের কাজ নিয়েছিলেন। আমরা একা ছিলাম আর সেইসঙ্গে মায়ের অনেক উদ্বিগ্নতা ছিল এবং আমাকে ওয়ার্কশপ সামলাতে হয়েছিল। একদিন মা তার দাদাবাবু অর্থাৎ আমার মেসো ইয়ুহানের সঙ্গে দেখা করতে যান। জগৎ পরিস্থিতির বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে মা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন: “ইয়ুহান, সবসময় কি এভাবেই চলতে থাকবে?”

“না, রূৎ,” তিনি বলেছিলেন। তিনি মাকে দুষ্টতা শেষ করার এবং রাজা হিসেবে যিশু খ্রিস্টসহ এক রাজ্যের মাধ্যমে পৃথিবীতে ধার্মিক শাসন নিয়ে আসার বিষয়ে ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা সম্বন্ধে বলে চলেন। (যিশাইয় ৯:৬, ৭; দানিয়েল ২:৪৪) তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, যিশু আমাদের যে-রাজ্যের জন্য প্রার্থনা করতে শিখিয়েছিলেন, সেটা ছিল এক ধার্মিক শাসন বা সরকার, যা পৃথিবীতে এক পরমদেশ নিয়ে আসবে।—মথি ৬:৯, ১০; প্রকাশিত বাক্য ২১:৩, ৪.

বাইবেলের সেই প্রতিজ্ঞাগুলো মায়ের হৃদয়ের গভীরে পৌঁছেছিল। তিনি ঘরে ফেরার সময় সারাটা পথ ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতে থাকেন। কিন্তু, মা যে ধর্মের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন, সেই বিষয়টা বাবা অথবা আমি কেউই পছন্দ করিনি। এই সময়ে, ১৯৩০ এর দশকের মাঝামাঝি আমি পশ্চিম সুইডেনের ট্রলহেটেনে চলে আসি, যেখানে আমি একটা বড় ওয়ার্কশপে একটা চাকরি পাই। শীঘ্রই মা ও সেইসঙ্গে বাবা, যিনি সবেমাত্র নাবিকের কাজ থেকে ফিরে এসেছিলেন, তারা সেই এলাকায় চলে আসে। ফলে, আমাদের পরিবার আবারও একতাবদ্ধ হয়।

তার আধ্যাত্মিক ক্ষুধা মেটানোর জন্য মা সেই এলাকার যিহোবার সাক্ষিদের খুঁজে বের করেছিলেন। সেই সময়ে তারা একেক জনের ঘরে মিলিত হতো, যেমনটা প্রাথমিক খ্রিস্টানরা করত। (ফিলীমন ১, ২) একদিন সভার জন্য মার ঘর ব্যবহার করতে দেওয়ার পালা ছিল। উৎকণ্ঠার সঙ্গে তিনি বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, তিনি তার বন্ধুদের ঘরে আমন্ত্রণ জানাতে পারেন কি না। বাবা উত্তর দিয়েছিলেন, “তোমার বন্ধুরা তো আমারও বন্ধু।”

তাই, আমাদের ঘরে লোকেদের অভ্যর্থনা জানানো হতো। লোকেরা যখন দরজা দিয়ে ঢুকতো, তখন আমি বের হয়ে যেতাম। কিন্তু, খুব শীঘ্রই আমিও সেখানে উপস্থিত থাকতে শুরু করেছিলাম। সাক্ষিদের বন্ধুত্বপরায়ণতা এবং তাদের বাস্তব, সহজ-সরল যুক্তি আমার মন থেকে সমস্ত ভুল ধারণা দূর করে দিয়েছিল। আমার হৃদয়ে এক বীজ অঙ্কুরিত হতে শুরু করেছিল—ভবিষ্যতের জন্য এক আশা।

সমুদ্রে যাত্রা করা

আমার রক্তে নিশ্চয়ই বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সমুদ্রের নেশা ছিল, যেকারণে আমিও সমুদ্রে যাত্রা করেছিলাম। এ ছাড়া, আমি আমার আধ্যাত্মিক চাহিদার বিষয়ে আরও বেশি সচেতন হয়ে উঠেছিলাম। যখনই আমাদের জাহাজ কোনো বন্দরে নোঙ্গর করত, তখন আমি সবসময় যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতাম। হল্যান্ডের (এখন নেদারল্যান্ডস) আমস্টারডামে আমি একটা ডাকঘরে জিজ্ঞেস করার জন্য গিয়েছিলাম যে, সাক্ষিদের আমি কোথায় পেতে পারি। কিছু সময় কথা বলার পর, আমি একটা ঠিকানা পেয়েছিলাম এবং সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে চলে গিয়েছিলাম। দশ বছর বয়সি একটা মেয়ে দরজায় আমাকে উষ্ণভাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। আমি একজন অপরিচিত ব্যক্তি ছিলাম, তবুও আমি তখনই সেই মেয়ে এবং তার পরিবারের সঙ্গে এক ঘনিষ্ঠ বন্ধন—চমৎকার আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃসমাজের এক অভিজ্ঞতা—অনুভব করেছিলাম!

যদিও আমাদের ভাষা এক ছিল না, তবুও সেই পরিবার যখন একটা ক্যালেন্ডার ও রেলগাড়ির সময়সূচি বের করে একটা মানচিত্র আঁকতে শুরু করেছিল, তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, নিকটবর্তী শহর হার্লেমে একটা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আমিও সেখানে গিয়েছিলাম আর কোনো কথা বুঝতে না পারলেও আমি তা পুরোপুরি উপভোগ করেছিলাম। যখন আমি দেখেছিলাম যে, সাক্ষিরা রবিবারের জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রণপত্র বিলি করছে, তখন আমিও তাতে অংশ নেওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। তাই, আমি লোকেদের ফেলে দেওয়া আমন্ত্রণপত্রগুলো কুড়িয়ে নিয়ে পুনরায় লোকেদের কাছে বিলি করেছিলাম।

একবার আমরা আর্জেন্টিনার বুয়েনস এরিস বন্দরে জাহাজ নোঙ্গর করি এবং সেখানে আমি যিহোবার সাক্ষিদের শাখা অফিস খুঁজে পাই। ভিতরে একটা অফিস এবং স্টোররুম ছিল। ডেস্কে একজন মহিলা বসে উল বুনছিলেন এবং একটা ছোট্ট মেয়ে, সম্ভবত সেই মহিলার মেয়ে, একটা পুতুল নিয়ে খেলা করছিল। তখন বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল এবং একজন পুরুষ একটা শেলফ থেকে কয়েকটা বই নিচ্ছিলেন, যেগুলোর মধ্যে সুইডিশ ভাষার সৃষ্টি (ইংরেজি) বইটি ছিল। তাদের সুখী, হাসিখুশি মুখ দেখে আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমিও এই লোকেদের অংশ হতে চাই।

বাড়ির দিকে ফেরার সময় আমাদের জাহাজ কানাডার একটা সামরিক বিমানের চালকদের তুলে নিয়েছিল, যেটা নিউফাউন্ডল্যান্ডের উপকূলে বিধ্বস্ত হয়েছিল। অল্প কয়েকদিন পর আমরা স্কটল্যান্ডের কাছাকাছি পৌঁছেছিলাম, যেখানে ইংল্যান্ডের নৌবাহিনীর একটা জাহাজ আমাদের জাহাজ আটক করেছিল। তদন্তের জন্য আমাদেরকে ওর্কনি দ্বীপের কুর্কওয়ালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল আর হিটলারের নাৎসিবাহিনী ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পোল্যান্ড আক্রমণ করেছিল। কয়েক দিন পর, আমাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল আর কোনোরকম সমস্যা ছাড়াই আমরা সুইডেনে ফিরে এসেছিলাম।

আমি শুধুমাত্র শারীরিকভাবেই বাড়িতে ফিরে আসিনি কিন্তু সেইসঙ্গে এখন আমি ঈশ্বরের সঙ্গে আমার সম্পর্কের প্রতিও মনোযোগ দিতে সমর্থ ছিলাম। এখন আমি সত্যি সত্যিই ঈশ্বরের লোকেদের অংশ হতে চেয়েছিলাম এবং তাদের সঙ্গে সমাজে সভাস্থ হওয়া পরিত্যাগ করতে চাইনি। (ইব্রীয় ১০:২৪, ২৫) এই বিষয়টা স্মরণ করে আমি আনন্দিত হই যে, একজন নাবিক হিসেবে আমি সবসময় অন্য নাবিকদের কাছে সাক্ষ্য দিয়েছি আর আমি জানি যে, তাদের মধ্যে একজন সাক্ষিও হয়েছিলেন।

এক বিশেষ ধরনের সেবা

১৯৪০ সালের প্রথম দিকে, আমি স্টকহোমে যিহোবার সাক্ষিদের শাখা অফিস পরিদর্শন করেছিলাম। আমাকে ইয়ুহান এইচ. ইনেরোট অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন, যিনি সেই সময়ে সুইডেনে প্রচার কাজ দেখাশোনা করার কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আমি যখন তাকে বলেছিলাম যে, আমি একজন অগ্রগামী পরিচারক হিসেবে পূর্ণসময়ের প্রচার কাজে অংশ নিতে চাই, তখন তিনি একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনি কি বিশ্বাস করেন যে, এটা হচ্ছে ঈশ্বরের সংগঠন?”

“হ্যাঁ,” আমি উত্তর দিই। এর ফলে, ১৯৪০ সালের ২২শে জুন আমি বাপ্তিস্ম নিই এবং শাখা অফিসে চমৎকার সহকর্মীদের সঙ্গে মনোরম পরিবেশে সেবা করতে শুরু করি। আমাদের সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো আমরা পরিচর্যায় ব্যয় করতাম। গ্রীষ্মকালে, আমরা প্রায়ই সাইকেলে চড়ে দূরবর্তী এলাকাগুলোতে চলে যেতাম এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোর পুরোটাই প্রচার করার জন্য ব্যবহার করতাম আর রাতে খড়ের গাদায় ঘুমাতাম।

কিন্তু, বেশির ভাগ সময় আমরা ঘরে ঘরেই প্রচার করতাম আর তা স্টকহোমের আশেপাশেই। একবার, আমি একটা লোককে তার ভূগর্ভস্থ ঘরে মরিয়া হয়ে নিজের গরম জল সরবরাহ করার ট্যাঙ্কে কাজ করতে দেখি। তাই, আমি আমার শার্টের হাতা গুটাই এবং তাকে সাহায্য করি। যখন সেই ট্যাঙ্কের ছিদ্র বন্ধ হয়, তখন লোকটি আমার দিকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাকিয়ে বলেন: “আমার মনে হয় আপনি সম্ভবত অন্য কোনো কারণে এখানে এসেছেন। তাই আসুন আমরা ওপরে গিয়ে হাত ধুই আর এক কাপ কফি খাই।” আমরা তা-ই করি আর কফি খাওয়ার সময় আমি তার কাছে সাক্ষ্য দিই। পরে, তিনি একজন সহখ্রিস্টান হন।

যদিও সুইডেন ঘোষণা করেছিল যে, তারা যুদ্ধের ব্যাপারে নিরপেক্ষ কিন্তু তারপরও সুইডেনের লোকেরা যুদ্ধের কারণে প্রভাবিত হয়েছিল। ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় পুরুষদের সৈন্যবাহিনীতে কাজ করার জন্য ডাকা হয়েছিল, যাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। যখন আমি সামরিক কুচকাওয়াজ করতে অস্বীকার করেছিলাম, তখন আমাকে স্বল্প সময়ের জন্য কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। পরে, আমাকে একটা বন্দি শিবিরে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। যুবক সাক্ষিদেরকে প্রায়ই বিচারকদের সামনে ডেকে পাঠানো হতো আর তখন আমরা ঈশ্বরের রাজ্যের বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে সমর্থ হয়েছিলাম। এটা যিশুর এই ভবিষ্যদ্বাণী পরিপূর্ণ করেছিল: “আমার জন্য তোমরা দেশাধ্যক্ষ ও রাজাদের সম্মুখে, তাহাদের ও পরজাতিগণের কাছে সাক্ষ্য দিবার জন্য, নীত হইবে।”—মথি ১০:১৮.

আমার জীবনে পরিবর্তন আসে

১৯৪৫ সালে ইউরোপে যুদ্ধ শেষ হয়। পরে সেই বছর নেথেন এইচ. নর, যিনি সেই সময়ে পৃথিবীব্যাপী কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তিনি তার সচিব মিলটন হেনশেলকে নিয়ে ব্রুকলিন থেকে আমাদেরকে পরিদর্শন করতে আসেন। তাদের পরিদর্শন সুইডেনে প্রচার কাজকে পুনর্গঠিত করার ক্ষেত্রে—এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য—বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়। যখন আমি ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অভ্‌ গিলিয়েডে যোগদান করার সম্ভাবনা সম্বন্ধে শুনি, তখন দেরি না করে আমি আবেদন করি।

পরের বছর, আমি সেই স্কুলের একটা ক্লাসরুমে বসেছিলাম, যেটা তখন নিউ ইয়র্কের সাউথ ল্যানসিংয়ের কাছে অবস্থিত ছিল। পাঁচ মাসের কোর্স চলাকালীন আমি যে-প্রশিক্ষণ পেয়েছিলাম, তা বাইবেল এবং ঈশ্বরের সংগঠনের প্রতি আমার উপলব্ধিকে আরও গভীর করেছিল। আমি দেখেছি যে, পৃথিবীব্যাপী প্রচার কাজে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিল, তারা বন্ধুত্বপরায়ণ এবং বিবেচনাপূর্ণ ছিল। তারা আমাদের বাকি সকলের সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করেছিল। (মথি ২৪:১৪) এই বিষয়টা যদিও আমাকে অবাক করেনি, তবুও নিজের চোখে বিষয়টা দেখে আমি আনন্দিত হয়েছিলাম।

শীঘ্রই ১৯৪৭ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি, গিলিয়েড স্কুলের অষ্টম ক্লাসের গ্র্যাজুয়েট হওয়ার দিন এসেছিল। আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের কোন কোন দেশে পাঠানো হবে, ভাই নর তা ঘোষণা করেছিলেন। যখন আমার পালা এসেছিল, তিনি বলেছিলেন, “ভাই প্রামবারি তার ভাইদের সেবা করার জন্য সুইডেনে ফিরে যাচ্ছেন।” আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আমি খুব একটা উদ্দীপনা অনুভব করিনি।

এক বিরাট প্রতিদ্বন্দ্বিতার মোকাবিলা করা

আমি যখন সুইডেনে ফিরে এসেছিলাম, তখন জেনেছিলাম যে, পৃথিবীব্যাপী অনেক দেশে এক নতুন কাজ—জেলার কাজ—শুরু হতে যাচ্ছে। আমাকে সুইডেনে প্রথম জেলা অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল আর আমার কার্যভার ছিল পুরো দেশের কাজ দেখাশোনা করা। আমি সুইডেনের সর্বত্র শহর ও নগরগুলোতে অনুষ্ঠিত সেই সম্মেলনগুলোর আয়োজন ও দেখাশোনা করেছিলাম, যেগুলো পরে সীমা সম্মেলন নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। যেহেতু এই আয়োজন পুরোপুরি নতুন ছিল, তাই আমি খুব অল্পই নির্দেশনা পেয়েছিলাম। ভাই ইনেরোট এবং আমি একত্রে বসে আমাদের যথাসাধ্য করে একটা কার্যক্রম প্রস্তুত করেছিলাম। এই কার্যভার পেয়ে আমি অনেক ভয় পেয়েছিলাম এবং অনেকবার প্রার্থনায় যিহোবার নিকটবর্তী হয়েছিলাম। ১৫ বছর ধরে আমি জেলার কাজ করার বিশেষ সুযোগ পেয়েছিলাম।

সেই সময়ে, উপযুক্ত সভাস্থল খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। আমাদেরকে নাচের হল এবং এই ধরনের স্থানগুলো দিয়ে কাজ চালাতে হতো, যেগুলো প্রায়ই স্বল্প উত্তাপবিশিষ্ট ছিল এবং মাঝে মাঝে উপযুক্তভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো না। ফিনল্যান্ডের রোকিওতে একটা সম্মেলন ছিল এর এক আদর্শ উদাহরণ। এই হলটা ছিল একটা পুরোনো কমিউনিটি সেন্টার, যেটা বেশ কিছু সময় ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। তুষার ঝড় হচ্ছিল আর তাপমাত্রা ছিল হিমাঙ্কের নীচে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাই, আমরা তেলের ড্রাম দিয়ে তৈরি দুটো বিশাল চুল্লি জ্বালিয়েছিলাম। কিন্তু আমরা জানতামই না যে, চিমনির মধ্যে পাখিরা তাদের বাসা তৈরি করেছে। অতএব জায়গাটা ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছিল! যদিও ওভারকোট দিয়ে নিজেদের ঢেকে রাখতে হয়েছিল ও চোখ জ্বালা করছিল, তবুও প্রত্যেকে নিজের আসনে বসে ছিল। এই ঘটনা সেই সম্মেলনকে বিশেষভাবে স্মরণীয় করে রেখেছে।

তিন দিনের এই সীমা সম্মেলনগুলো সংগঠিত করার নির্দেশনাগুলোর মধ্যে অভ্যাগতদের জন্য খাবার প্রস্তুত করার নির্দেশনাও ছিল। প্রথমদিকে, আমাদের এই ধরনের এক কার্যভার সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু আমাদের চমৎকার ভাই ও বোনেরা ছিল, যারা আনন্দের সঙ্গে এই কঠিন কার্যভার গ্রহণ করেছিল। সম্মেলনের আগের দিন, আপনি দেখতে পেতেন যে, একটা খোলা বড় পাত্রের দিকে ঝুঁকে আলুর খোসা ছাড়ানোর সময় তারা বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছে আর এক চমৎকার সময় কাটাচ্ছে। এই উপলক্ষগুলোতে ভাইবোনেরা একত্রে কঠোর পরিশ্রম করার সময় অনেকের মধ্যে স্থায়ী বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।

এই সীমা সম্মেলনগুলোর বিষয়ে বিজ্ঞাপনের জন্য তখন প্ল্যাকার্ড নিয়ে হাঁটাও আমাদের কাজের আরেকটা বৈশিষ্ট্য ছিল। আমরা শোভাযাত্রা করে একটা শহর বা গ্রামের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতাম, অধিবাসীদেরকে জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতায় আমন্ত্রণ জানাতাম। সাধারণত অধিকাংশ লোকই দয়ালু ও শ্রদ্ধাশীল ছিল। একবার ফিনস্‌পোং শহরের রাস্তায় একটা কারখানা থেকে কর্মীরা লাইন করে বের হয়ে আসছিল। হঠাৎ, তাদের মধ্যে একজন চিৎকার করে বলে উঠেছিল: “শোনো বন্ধুরা, এরাই হচ্ছে সেই লোক, যাদের ওপর হিটলার জয়ী হতে পারেননি!”

আমার জীবনের এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা

চমৎকার একজন যুবতী কারিনের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর, শীঘ্রই ভ্রমণ পরিচারক হিসেবে আমার জীবন পরিবর্তিত হয়। আমাদের উভয়কেই ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে নিউ ইয়র্ক সিটির ইয়াংকি স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে ২০ তারিখ, সোমবার বিরতির সময় মিলটন হেনশেল আমাদের বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পাদন করেন। এটা সেই বিখ্যাত বেইসবল স্টেডিয়ামে একটা অসাধারণ ঘটনাই ছিল। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত একসঙ্গে ভ্রমণের কাজ করার পর কারিন এবং আমাকে সুইডেনের বেথেল পরিবারে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্রথমে, আমি পত্রিকা বিভাগে কাজ করি। একজন মেকানিক হিসেবে আমার প্রশিক্ষণ ছিল বলে পরে আমাকে শাখার ছাপাখানা এবং অন্যান্য মেশিন দেখাশোনা করার জন্য নিযুক্ত করা হয়। কারিন বেশ কয়েক বছর লন্ড্রিতে কাজ করে। বর্তমানে, অনেক বছর ধরে সে প্রুফরিডিং বিভাগে সেবা করে চলেছে।

বিবাহিত দম্পতি হিসেবে আমরা যিহোবার সেবায় ৫৪ বছরের অধিক সময় ধরে কতই না ঘটনাবহুল, অর্থপূর্ণ, সুখী এক জীবন উপভোগ করেছি! যিহোবা তাঁর প্রেমময়, কঠোর পরিশ্রমী দাসদের নিয়ে গঠিত সংগঠনকে সত্যিই আশীর্বাদ করেছেন। ১৯৪০ সালে যখন আমি শাখা অফিসে সেবা করতে শুরু করেছিলাম, তখন সুইডেনে শুধুমাত্র ১,৫০০ জন সাক্ষি ছিল। কিন্তু, এখন সেখানে ২২,০০০রেরও বেশি সাক্ষি রয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য অংশে আরও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি হচ্ছে আর তাই পৃথিবীব্যাপী এখন পয়ষট্টি লক্ষেরও বেশি সাক্ষি রয়েছে।

আমাদের কাজের পিছনে যিহোবার আত্মা রয়েছে, আমাদের রূপক জাহাজকে যেন অবিরত পূর্ণ করে চলেছে। বিশ্বাসের চোখে আমরা মানবজাতির অস্থির সমুদ্রের ওপর স্থির দৃষ্টি রেখেছি কিন্তু আমরা ভীত নই। আমাদের সামনে আমরা স্পষ্টতই ঈশ্বরের নতুন জগৎ দেখতে পাচ্ছি। কারিন এবং আমি ঈশ্বরকে তাঁর সমস্ত মঙ্গলভাবের জন্য ধন্যবাদ দিই আর আমাদের নীতিনিষ্ঠা বজায় রাখার জন্য এবং অবশেষে আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে অর্থাৎ ঈশ্বরের অনুমোদন এবং অনন্তজীবন লাভ করতে শক্তির জন্য রোজ প্রার্থনা করি!—মথি ২৪:১৩.

[১২ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমার মায়ের কোলের ওপর

[১৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯২০ এর দশকের প্রথম দিকে যেখানে বাবা এবং আমি ছোটখাটো একটা জাহাজ চালিয়েছিলাম

[১৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৪৬ সালে গিলিয়েডে হারম্যান হেনশেলের (মিলটনের বাবার) সঙ্গে

[১৬ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

১৯৫৩ সালের ২০শে জুলাই ইয়াংকি স্টেডিয়ামে আমাদের বিয়ে হয়