সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

আমার বাবামার উদাহরণ আমাকে শক্তিশালী করেছিল

আমার বাবামার উদাহরণ আমাকে শক্তিশালী করেছিল

জীবন কাহিনী

আমার বাবামার উদাহরণ আমাকে শক্তিশালী করেছিল

বলেছেন ইয়ানেজ রিকেল

১৯৫৮ সালের কথা। আমার স্ত্রী স্টান্‌কা এবং আমি ইউগোস্লাভ-অস্ট্রিয়ার সীমান্তে অবস্থিত আল্পস পর্বতমালার কারাভাংকেনের একেবারে উঁচুতে ছিলাম, অস্ট্রিয়াতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। এটা অত্যন্ত বিপদজনক ছিল কারণ ইউগোস্লাভ সীমান্তে সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীরা কাউকে সেই সীমান্ত অতিক্রম না করতে দেওয়ার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিল। আমরা যখন এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন খাড়া পাহাড়ের একেবারে কিনারায় চলে আসি। স্টান্‌কা এবং আমি এর আগে কখনো অস্ট্রিয়া অঞ্চলের দিক থেকে পর্বতমালা দেখিনি। আমরা নুড়ি এবং কাঁকরের এক এবড়োখেবড়ো ঢালু স্থানে আসার আগে পর্যন্ত পূর্ব দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমরা যে-ত্রিপল বহন করছিলাম, সেটার সঙ্গে নিজেদের বেঁধে আমরা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উদ্দেশে পবর্তের উতরাই বেয়ে বেয়ে নামছিলাম।

 আমাকে বলতে দিন যে, কীভাবে আমরা এইরকম পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম আর কীভাবে আমার বাবামার বিশ্বস্ত উদাহরণ আমাকে কঠিন সময়গুলোতে যিহোবার প্রতি অনুগত থাকতে অনুপ্রাণিত করেছে।

আমি স্লোভিনিয়ায় বড় হয়েছি, যেটা বর্তমানে মধ্য ইউরোপের একটা ছোট্ট দেশ। এটা ইউরোপীয় আল্পস পর্বতমালার কাছে অবস্থিত, যেটার উত্তরে রয়েছে অস্ট্রিয়া, পশ্চিমে ইতালি, দক্ষিণে ক্রোয়েশিয়া এবং পূর্বে হাঙ্গারি। কিন্তু, আমার বাবামা ফ্রান্ট্‌স্‌ এবং রোজালিয়া রিকেল যখন জন্মগ্রহণ করেছিল, তখন স্লোভিনিয়া অস্ট্রো-হাঙ্গারীয় সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। ১ম বিশ্বযুদ্ধের শেষে, স্লোভিনিয়া একটা নতুন রাষ্ট্রের অংশ হয়েছিল, যেটাকে বলা হতো সার্বীয়, ক্রোয়েশীয়, স্লোভিনীয় রাজ্য। ১৯২৯ সালে সেই দেশের নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় ইউগোস্লাভিয়া, যার আক্ষরিক অর্থ “দক্ষিণ স্লাভিয়া।” সেই একই বছরের ৯ই জানুয়ারি চমৎকার ব্লেড লেকের নিকটবর্তী পোডহোম গ্রামের সীমান্তে আমার জন্ম হয়।

মা এক গোঁড়া ক্যাথলিক পরিবারে বড় হয়েছিলেন। তার একজন কাকা যাজক ছিলেন এবং তিন জন পিসি নান ছিল। একটি বাইবেল পাওয়ার, সেটি পড়ার এবং তা বোঝার জন্য তার প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু, বাবার ধর্ম সম্বন্ধে খুব একটা ভাল দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। ১৯১৪-১৮ সাল পর্যন্ত মহাযুদ্ধে ধর্মের ভূমিকা দেখে তিনি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন।

সত্য শেখা

যুদ্ধের কিছু সময় পরে, আমার মার কাকাতো ভাই ইয়ানেজ ব্রেইয়েস এবং তার স্ত্রী আঞ্চ্‌কা বাইবেল ছাত্র হয়, যে-নামে যিহোবার সাক্ষিরা সেই সময় পরিচিত ছিল। সেই সময় তারা অস্ট্রিয়াতে থাকত। প্রায় ১৯৩৬ সালের পর থেকে আঞ্চ্‌কা বেশ কয়েক বার আমার মার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। তিনি মাকে একটি বাইবেল দেন, যেটি পাওয়া মাত্র মা পড়ে ফেলেন ও সেইসঙ্গে স্লোভিনীয় ভাষার প্রহরীদুর্গ পত্রিকার কয়েকটি কপি এবং বাইবেলের অন্যান্য প্রকাশনা দেন। অবশেষে, ১৯৩৮ সালে হিটলার অস্ট্রিয়া অধিকার করার কারণে ইয়ানেজ এবং আঞ্চ্‌কা স্লোভিনিয়ায় ফিরে আসে। আমার মনে আছে যে, তারা সুশিক্ষিত, বিবেচক দম্পতি ছিল, যাদের যিহোবার প্রতি প্রকৃত প্রেম ছিল। তারা প্রায়ই মার সঙ্গে বাইবেলের সত্য নিয়ে আলোচনা করত, যা তাকে যিহোবার কাছে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে পরিচালিত করেছিল। তিনি ১৯৩৮ সালে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন।

মা যখন অশাস্ত্রীয় প্রথাগুলো, যেমন বড়দিন উদ্‌যাপন করা বন্ধ করে দেন; যখন তিনি আর রক্তসহ সসেজ খেতেন না; এবং বিশেষ করে যখন তিনি আমাদের সমস্ত মূর্তি নিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন, তখন এগুলো নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বিরোধিতা আসতে খুব বেশি সময় লাগেনি। মায়ের যে-পিসিরা নান ছিল, তারা তাকে চিঠি লিখে বোঝানোর চেষ্টা করত যেন সে মরিময়ের কাছে এবং গির্জায় ফিরে আসে। কিন্তু, মা যখন তাদেরকে চিঠি লিখে বাইবেলের নির্দিষ্ট কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জিজ্ঞেস করেন, তখন তিনি কোনো উত্তর পান না। আমার দাদু তার প্রচণ্ড বিরোধিতা করেন। তিনি আসলে অত নির্মম ব্যক্তি ছিলেন না কিন্তু আমাদের আত্মীয়স্বজন এবং সমাজ থেকে তাকে অনেক চাপের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এর ফলে, বেশ কয়েক বার তিনি মার বাইবেল সাহিত্যাদি পুড়িয়ে ফেলেন কিন্তু কখনো মার বাইবেল তিনি স্পর্শ করতেন না। তিনি হাঁটু গেড়ে মাকে মিনতি করেছিলেন, যেন তিনি গির্জায় ফিরে আসেন। এমনকি তিনি এমন এক পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন যে, মাকে ছুরি নিয়ে পর্যন্ত ভয় দেখিয়েছিলেন। কিন্তু, আমার বাবা কড়াভাবে দাদুকে বলেছিলেন যে, এই ধরনের আচরণ সহ্য করা হবে না।

বাইবেল পড়ার এবং তার বিশ্বাস সম্বন্ধে নিজেই বাছাই করার বিষয়ে মার অধিকারকে বাবা ক্রমাগত সমর্থন করে গিয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনিও বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন। বিরোধিতা সত্ত্বেও, সত্যের পক্ষে নির্ভীকভাবে দৃঢ় অবস্থান বজায় রাখার জন্য যিহোবা কীভাবে আমার মাকে শক্তিশালী করেছিলেন এবং তার বিশ্বাসের জন্য যিহোবা কীভাবে তাকে পুরস্কৃত করেছিলেন, তা দেখা আমাকে যিহোবার সঙ্গে আমার নিজের সম্পর্ক গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করেছিল। এ ছাড়া, আমার সামনে বাইবেল এবং বাইবেলভিত্তিক প্রকাশনা থেকে মার জোরে জোরে পড়ার অভ্যাস থেকেও আমি অনেক উপকৃত হয়েছিলাম।

মা তার বোন মারিয়া রিপির সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করতেন আর অবশেষে মারিয়া মাসি এবং আমি ১৯৪২ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে একই দিনে বাপ্তিস্ম নিই। একজন ভাই এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন এবং আমরা আমাদের বাড়িতে বিরাট কাঠের টাবে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জোরপূর্বক শ্রম করানো

১৯৪২ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে, জার্মানি এবং ইতালি স্লোভিনিয়া আক্রমণ করে এবং নিজেদের ও হাঙ্গারির মধ্যে এটাকে ভাগ করে নেয়। আমার বাবামা ফক্সবুন্ট অর্থাৎ নাৎসি লোকেদের সংগঠনে যোগ দিতে প্রত্যাখ্যান করে। আমি স্কুলে “হাইল হিটলার” বলতে প্রত্যাখ্যান করি। স্পষ্টতই, আমার শিক্ষক সেই পরিস্থিতির কথা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন।

আমাদেরকে একটা ট্রেনে ঢোকানো হয়, যেটা বাভেরিয়ার হুয়েটঁবাখ গ্রামের নিকটবর্তী দুর্গের দিকে যাচ্ছিল, যা জোরপূর্বক শ্রম শিবির হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। বাবা একজন স্থানীয় রুটি প্রস্তুতকারকের সঙ্গে আমার কাজ করার ও তার পরিবারের সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। সেই সময়ে, আমি রুটি তৈরির কাজ শিখি, যা পরে অনেক কাজে এসেছিল। পরে, আমার পরিবারের বাকি সকলে (সেইসঙ্গে মারিয়া মাসি ও তার পরিবার) গুনজেনহুজেন শিবিরে চলে আসে।

যুদ্ধ শেষে, আমার বাবামা যেখানে থাকে, সেখানে যাওয়ার জন্য আমি একদল লোকের সঙ্গে যোগ দেব বলে ঠিক করেছিলাম। আমি সেই স্থান ত্যাগ করার আগে বিকেল বেলা হঠাৎ করে বাবা আসেন। আমি যদি সেই দলের সঙ্গে যেতাম, তা হলে আমার কী অবস্থা হতো তা আমি জানি না, কারণ তারা নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি ছিল না। আবারও আমি যিহোবার প্রেমময় যত্ন সম্বন্ধে অনুভব করেছিলাম, যখন তিনি আমাকে সুরক্ষা করার এবং প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য আমার বাবামাকে ব্যবহার করেছিলেন। বাবা এবং আমি আমাদের পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য তিন দিনের পথ হেঁটেছিলাম। ১৯৪৫ সালের জুন মাসে আমরা সবাই বাড়িতে ফিরে এসেছিলাম।

যুদ্ধের পরে রাষ্ট্রপতি ইয়সিপ ব্রোজ টিটোর নেতৃত্বে ইউগোস্লাভিয়ায় সাম্যবাদীরা ক্ষমতায় আসে। এর ফলে যিহোবার সাক্ষিদের অবস্থা কঠিনই থেকে যায়।

১৯৪৮ সালে অস্ট্রিয়া থেকে একজন ভাই আসেন এবং আমাদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেন। তিনি যে যে জায়গায় গিয়েছিলেন, পুলিশ তাকে অনুসরণ করেছিল এবং যে-ভাইদের কাছে তিনি গিয়েছিলেন, তাদেরকে গ্রেপ্তার করেছিল। তাকে আতিথেয়তা দেখানোর কারণে এবং তাকে পুলিশের হাতে তুলে না দেওয়ার জন্য বাবাকেও গ্রেপ্তার করা হয় এবং এর ফলে বাবাকে দুই বছর জেল খাটতে হয়। এটা মায়ের জন্য অনেক কঠিন সময় ছিল আর তা কেবল বাবার অনুপস্থিতির জন্যই নয় কিন্তু তিনি জানতেন যে শীঘ্রই আমার ছোট ভাই এবং আমাকেও নিরপেক্ষতার পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে।

মেসিডোনিয়ার জেলে

১৯৪৯ সালের নভেম্বর মাসে আমি সেনাবাহিনীতে কাজ করার জন্য ডাক পাই। আমি হাজিরা দিতে এবং কাজ না করার পিছনে আমার বিবেকের বিষয়ে ব্যাখ্যা করার জন্য যাই। কর্তৃপক্ষ আমার কথা শোনেনি এবং আমাকে একটা দলের সঙ্গে ট্রেনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়, যেটা ইউগোস্লাভিয়ার অন্য প্রান্তে মেসিডোনিয়ার দিকে যাচ্ছিল।

তিন বছর ধরে আমার পরিবার এবং ভ্রাতৃবর্গের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না এবং আমার কাছে কোনো সাহিত্য অথবা এমনকি একটি বাইবেলও ছিল না। এটা অত্যন্ত কঠিন সময় ছিল। যিহোবা এবং তাঁর পুত্র যিশু খ্রিস্টের উদাহরণ নিয়ে ধ্যান করার দ্বারা আমি টিকে ছিলাম। আমার বাবামার উদাহরণও আমাকে শক্তিশালী করেছিল। এ ছাড়া, শক্তির জন্য অবিরত প্রার্থনা আমাকে হতাশা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল।

পরবর্তী সময়ে, আমাকে স্কোপিয়ের নিকটবর্তী ইডরিজোভোর জেলে পাঠানো হয়েছিল। এই জেলে সহবন্দিরা বিভিন্ন কাজ এবং কারিগরি কাজ করত। প্রথমে, আমি পরিষ্কার করার কাজ এবং অফিসগুলোর মধ্যে একজন বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করতাম। যদিও আমাকে প্রায়ই এমন একজন বন্দির উৎপীড়ন সহ্য করতে হতো, যিনি গুপ্ত পুলিশের একজন প্রাক্তন সদস্য ছিলেন কিন্তু অন্য সকলের—প্রহরী, বন্দি, এমনকি জেলের কারখানার ম্যানেজারের—সঙ্গে আমার খুব ভাল সম্পর্ক ছিল।

পরে আমি জানতে পারি যে, জেলের বেকারির জন্য একজন রুটি প্রস্তুতকারকের প্রয়োজন। এর কিছুদিন পরে ম্যানেজার নাম ডাকার জন্য আসেন। তিনি লাইনের দিকে হেঁটে আসেন, আমার সামনে দাঁড়ান এবং জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি রুটি বানাতে পারো?” “হ্যাঁ, স্যার,” আমি উত্তর দিই। “আগামীকাল সকালে বেকারিতে আসবে,” তিনি বলেছিলেন। যে-বন্দি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন, তিনি প্রায়ই বেকারির সামনে দিয়ে যেতেন কিন্তু সেখানে কিছুই করতে পারতেন না। আমি সেখানে ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত কাজ করেছিলাম।

এরপর আমাকে বদলি করে মেসিডোনিয়ার দক্ষিণে প্রিসপা লেকের নিকটবর্তী ভোল্কোডারি ব্যারাকে পাঠানো হয়। কাছের ওটেশোভো শহর থেকে আমি বাড়িতে চিঠি লিখতে পারতাম। আমি রাস্তা নির্মাণকারী দলের সঙ্গে কাজ করতাম কিন্তু বেশির ভাগ সময় আমি বেকারিতে কাজ করতাম, যা আমার জন্য বিষয়গুলোকে সহজ করে দিয়েছিল। আমি ১৯৫২ সালের নভেম্বর মাসে মুক্তি পাই।

যে-সময়ে আমি পোডহোমে অনুপস্থিত ছিলাম, সেই সময়ে সেই এলাকায় মণ্ডলী গঠিত হয়েছিল। প্রথমে, মণ্ডলী স্পোডনি গোরির একটা গেস্টহাউসে মিলিত হতো। পরে, মণ্ডলী যাতে মিলিত হতে পারে এর জন্য বাবা আমাদের বাড়িতেই একটা কামরা ছেড়ে দিয়েছিলেন। মেসিডোনিয়া থেকে ফিরে এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে পেরে আমি আনন্দিত ছিলাম। আমি স্টান্‌কার সঙ্গে মেলামেশা করতে শুরু করি, যার সঙ্গে জেলে যাওয়ার আগে আমার পরিচয় হয়েছিল। ১৯৫৪ সালের ২৪শে এপ্রিল আমরা বিয়ে করি। কিন্তু, আমার সাময়িক বিরাম শীঘ্রই শেষ হতে যাচ্ছিল।

মারিবোরের জেলে

১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি আরেকটা ডাক পাই। এইবার আমি সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় মারিবোর, যা স্লোভিনিয়ার পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত, সেখানকার একটা জেলে সাজা পাই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি কিছু কাগজ এবং পেনসিল কিনি। আমি যা কিছু মনে করতে পেরেছিলাম, এমন সমস্তকিছু লিখতে শুরু করি—শাস্ত্রপদ, প্রহরীদুর্গ থেকে উদ্ধৃতি এবং অন্যান্য খ্রিস্টীয় প্রকাশনার মূল ধারণাগুলো। আমি আমার নোট পড়তাম এবং যখনই আরও কিছু মনে আসত সেগুলো আমার নোটবুকে লিখে রাখতাম। অবশেষে, সেই নোটবুক পূর্ণ হয়ে যায় এবং এটা আমাকে সত্যের প্রতি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত রাখতে এবং আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে দৃঢ় থাকতে সাহায্য করেছিল। প্রার্থনা এবং ধ্যানও আমার আধ্যাত্মিক শক্তির জন্য অমূল্য সহায়ক ছিল, যা আমাকে অন্যদের সঙ্গে সত্য ভাগ করে নিতে আরও শক্তিশালী করে তুলেছিল।

সেই সময়ে আমি মাসে একটা চিঠি পাওয়ার এবং মাসে একবার ১৫ মিনিট সাক্ষাৎ করার অনুমতি পেয়েছিলাম। স্টান্‌কা ট্রেনে করে সারারাত যাত্রা করে আসত, যাতে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য সে আগে আসতে পারে এবং এরপর সেইদিনেই আবার ফিরে যেত। সেই সাক্ষাৎগুলো আমার জন্য অনেক উৎসাহজনক ছিল। এরপর আমি কীভাবে একটি বাইবেল পাওয়া যায়, তার পরিকল্পনা করি। স্টান্‌কা এবং আমি একটা টেবিলে পরস্পর মুখোমুখি বসতাম আর আমাদের ওপর নজর রাখার জন্য একজন প্রহরী থাকতেন। প্রহরী যখন অন্য দিকে তাকিয়েছিলেন, তখন আমি তার হাতব্যাগে চুপিসারে একটা চিঠি ঢুকিয়ে দিই, তাকে বলি যাতে পরবর্তী সময়ে সে যখন আসবে তখন যেন তার ব্যাগে করে একটি বাইবেল নিয়ে আসে।

স্টান্‌কা এবং আমার বাবামা মনে করেছিল যে এটা খুবই বিপদজনক, তাই তারা খ্রিস্টান গ্রিক শাস্ত্রের একটি কপির পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে আলাদা করে এবং এর পৃষ্ঠাগুলো কিছু বানরুটির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। এভাবে আমি আমার যে-বাইবেলের দরকার ছিল সেটি পাই। সেই একইভাবে, আমি স্টান্‌কার হাতের লেখা প্রহরীদুর্গ পত্রিকা পাই। আমি সঙ্গে সঙ্গে নিজের হাতে আরেকটা কপি তৈরি করতাম এবং মূল লেখাটাকে নষ্ট করে ফেলতাম যাতে বোঝা না যায় যে, কোথা থেকে আমি প্রবন্ধগুলো পেয়েছি।

আমার অবিরত সাক্ষ্যদানের জন্য সহবন্দিরা বলে যে, আমি অবশ্যই সমস্যায় পড়ব। একবার আমি একজন সহবন্দির সঙ্গে প্রাণবন্ত বাইবেল আলোচনা করছিলাম। আমরা তালার মধ্যে চাবি ঢোকানোর শব্দ শুনি এবং একজন প্রহরী ভিতরে হেঁটে আসেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে মনে করেছিলাম যে, আমাকে নিঃসঙ্গ কারাবাস দেওয়া হবে। কিন্তু, প্রহরীর উদ্দেশ্য এটা ছিল না। তিনি আলোচনা শুনেছিলেন এবং আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। তার প্রশ্নের উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে তিনি চলে যান এবং সেই কক্ষের দরজায় তালা লাগিয়ে দেন।

আমার শাস্তির শেষ মাসে যে-কমিশনার সংশোধনের জেলের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি সত্যের প্রতি আমাদের দৃঢ় অবস্থানের জন্য প্রশংসা করেন। আমার মনে হয়েছিল যে, এটা ছিল যিহোবার নামকে জানানোর বিষয়ে আমার প্রচেষ্টার উত্তম পুরস্কার। ১৯৫৮ সালের মে মাসে আমি জেল থেকে আবারও ছাড়া পেয়েছিলাম।

অস্ট্রিয়ায় পালিয়ে যাওয়া এবং এরপর অস্ট্রেলিয়ায়

১৯৫৮ সালের আগস্ট মাসে আমার মা মারা যান। তিনি কিছুদিন যাবৎ অসুস্থ ছিলেন। এরপর ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি তৃতীয় বারের মতো ডাক পাই। সেই দিন সন্ধ্যায় স্টান্‌কা এবং আমি দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিই, যা আমাদেরকে নাটকীয়ভাবে সীমান্ত অতিক্রম করার সিদ্ধান্তের দিকে পরিচালিত করেছিল, যে-বিষয়ে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। কাউকে কিছু না বলে আমরা কয়েকটা ব্যাগ ও ত্রিপল প্যাক করি আর জানালা দিয়ে বেরিয়ে যাই এবং স্টোল পর্বতের পশ্চিমে অস্ট্রিয়ার দিকে এগোতে থাকি। মনে হয়েছিল যেন যিহোবা আমাদের জন্য পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন, যখন আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমাদের কিছু স্বস্তির প্রয়োজন ছিল।

অস্ট্রিয়ার কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে সল্জবার্গের নিকটবর্তী শরণার্থী শিবিরে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে ছয়মাস থাকাকালীন আমরা সবসময় স্থানীয় সাক্ষিদের সঙ্গে ছিলাম, তাই আমরা খুব অল্প সময়ই শিবিরে কাটিয়েছি। শিবিরে অন্যেরা অনেক অবাক হয়ে গিয়েছিল যে, এত তাড়াতাড়ি আমরা কীভাবে বন্ধু তৈরি করে ফেলেছি। সেই সময়ই আমরা প্রথম সম্মেলনে যোগ দিই। এ ছাড়া, সেই সময় আমরা প্রথম স্বাধীনভাবে ঘরে ঘরে প্রচারে যেতে পেরেছিলাম। বিদায় নেওয়ার সময় এই প্রিয় বন্ধুদের ছেড়ে আসা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছিল।

অস্ট্রিয়ার কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আমরা কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি যে, আমরা এত দূরে যাব। আমরা ইতালির জেনোয়াতে যাওয়ার ট্রেন ধরি এবং এরপর অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে যাওয়ার জন্য জাহাজে চড়ি। আমরা অবশেষে নিউ সাউথ ওয়েলসের ওলনগংয়ে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করি। সেখানে ১৯৬৫ সালের ৩০শে মার্চ আমাদের ছেলে ফিলিপ জন্মগ্রহণ করে।

অস্ট্রেলিয়ায় বাস করা আমাদের সেবা করার অনেক দিক খুলে দিয়েছিল, যার অন্তর্ভুক্ত সেই লোকেদের কাছে প্রচার করা, যারা আগে ইউগোস্লাভিয়া হিসেবে পরিচিত এলাকা থেকে এসেছে। যিহোবার আশীর্বাদের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ, যার অন্তর্ভুক্ত এক ঐক্যবদ্ধ পরিবার হিসেবে তাকে সেবা করতে পারার সুযোগ। ফিলিপ এবং তার স্ত্রী সুজির অস্ট্রেলিয়ায় যিহোবার সাক্ষিদের শাখা অফিসে কাজ করার সুযোগ হয়েছে এবং এমনকি তাদের স্লোভানিয়ার শাখা অফিসে দুই বছর সেবা করারও সুযোগ হয়েছে।

বার্ধক্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং স্বাস্থ্যগত সমস্যাগুলো থাকা সত্ত্বেও, আমার স্ত্রী এবং আমি ক্রমাগত যিহোবার সেবা করে গিয়েছি। আমি আমার বাবামার উত্তম উদাহরণের জন্য অত্যন্ত কৃতজ্ঞ! এটা এখনও আমাকে শক্তিশালী করে, প্রেরিত পৌল যা বলেছিলেন, তা করতে সাহায্য করে: “প্রত্যাশায় আনন্দ কর, ক্লেশে ধৈর্য্যশীল হও, প্রার্থনায় নিবিষ্ট থাক।”—রোমীয় ১২:১২.

[১৬, ১৭ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯২০ এর দশকের শেষের দিকে আমার বাবামা

[১৭ পৃষ্ঠার চিত্র]

একেবারে ডান দিকে আমার মা আঞ্চ্‌কার সঙ্গে, যিনি তাকে সত্য শিখিয়েছিলেন

[১৮ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমার স্ত্রী স্টান্‌কার সঙ্গে, আমাদের বিয়ের কিছুদিন পরে

[১৯ পৃষ্ঠার চিত্র]

সেই মণ্ডলী যেটা ১৯৫৫ সালে আমাদের বাড়িতে মিলিত হতো

[২০ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমার স্ত্রী, আমাদের ছেলে ফিলিপ এবং তার স্ত্রী সুজির সঙ্গে