সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

জীবনকাহিনি

আমি আমার হাত শিথিল হতে না দেওয়ার বিষয়ে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ

আমি আমার হাত শিথিল হতে না দেওয়ার বিষয়ে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ

“ড্যাডি,” “পাপা,” “আঙ্কেল।” বেথেলের অনেক অল্পবয়সি আমাকে এভাবেই ডেকে থাকে। আর যেহেতু আমার বয়স এখন ৮৯ বছর, তাই এভাবে ডাকলে আমার ভালো লাগে। আমি এই স্নেহের অভিব্যক্তিগুলোকে যিহোবার কাছ থেকে পাওয়া পুরস্কারের এক অংশ হিসেবে দেখি, যা তিনি আমাকে তাঁর প্রতি করা আমার ৭২ বছরের পূর্ণসময়ের সেবার জন্য দিয়েছেন। আর ঈশ্বরের সেবায় আমার অভিজ্ঞতাগুলোর উপর ভিত্তি করে আমি এই কথাগুলো বলার মাধ্যমে সেই অল্পবয়সিদের মন থেকে আশ্বস্ত করতে পারি: ‘তোমাদের কার্য্য পুরস্কৃত হইবে—যদি তোমাদের হস্ত শিথিল না হয়।’—২ বংশা. ১৫:৭.

আমার বাবা-মা ও ভাই-বোনেরা

আমার বাবা-মা ইউক্রেন থেকে কানাডায় বসবাস করার জন্য চলে আসেন। তারা ম্যানিটোবা প্রদেশের রসবার্ন শহরে থাকতে শুরু করেন। আমরা মোট ১৬ জন ভাই-বোন—আট ভাই ও আট বোন, তবে কেউই যমজ নয়। আমি হলাম ১৪তম সন্তান। বাবা বাইবেলকে খুব ভালোবাসতেন আর তিনি প্রতি রবিবার সকালে আমাদের বাইবেল পড়ে শোনাতেন। তবে তিনি মনে করতেন, ধর্মীয় নেতারা লোকেদের কাছ থেকে অর্থ পাওয়ার বিষয়ে বেশি আগ্রহী। তিনি প্রায়ই মজা করে জিজ্ঞেস করতেন, “যিশুর প্রচার ও শিক্ষাদানের কাজের জন্য কে তাঁকে টাকা দিত, কে জানে?”

আমার ভাই-বোনদের মধ্যে আট জন—চার ভাই ও চার বোন—অবশেষে সত্য গ্রহণ করে। আমার এক দিদির নাম রোজ। সে মৃত্যু পর্যন্ত অগ্রগামীর কাজ করে যায়। মারা যাওয়ার আগে দিদি সবাইকে ঈশ্বরের বাক্যের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করে বলত, “আমি নতুন জগতে তোমাদের দেখতে চাই।” আমার দাদা টেড প্রথমে নরকাগ্নির বিষয়ে প্রচার করত। প্রতি রবিবার সকালে, দাদা রেডিওতে প্রচার করত এবং শ্রোতাদের বার বার জোর দিয়ে বলত যে, পাপীরা নরকের অনন্ত আগুনে চিরকাল ধরে পুড়বে। তবে, পরবর্তী সময়ে দাদা যিহোবার একজন বিশ্বস্ত ও উদ্যোগী দাস হয়ে উঠেছিল।

যেভাবে আমি পূর্ণসময়ের সেবা শুরু করি

১৯৪৪ সালের জুন মাসে, একদিন আমি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখি, আমাদের খাবারের টেবিলে জগতের আসন্ন পুনর্সংস্কার  * (ইংরেজি) শিরোনামের একটা পুস্তিকা পড়ে আছে। আমি পুস্তিকাটা পড়তে শুরু করার পর আর থামতেই পারিনি। পুরো পুস্তিকাটা পড়ে শেষ করার পর আমি একটা সিদ্ধান্ত নিই—আমিও ঠিক যিশুর মতো যিহোবার সেবা করতে চাই।

কীভাবে সেই পুস্তিকা আমাদের টেবিলের উপর এসে পৌঁছেছিল? আমার দাদা স্টিভ বলে যে, দু-জন ব্যক্তি বই ও পুস্তিকা ‘বিক্রি’ করতে করতে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। দাদা বলে, ‘ওটা খুব সস্তায় বিক্রি হচ্ছিল, তাই কিনেছি।’ পরের রবিবার, সেই দু-জন ব্যক্তি ফিরে আসেন। তারা আমাদের বলেন যে, তারা হলেন যিহোবার সাক্ষি আর তারা বাইবেল ব্যবহার করে লোকেদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকেন। এটা শুনে আমাদের খুব ভালো লাগে কারণ বাবা-মা আমাদের ছোটো থেকেই ঈশ্বরের বাক্যের প্রতি সম্মান দেখাতে শিখিয়েছিলেন। সেই সাক্ষিরা আমাদের এও বলেন যে, খুব শীঘ্রই উইনিপেগ শহরে সাক্ষিদের একটা সম্মেলন হবে, যেখানে আমার দিদি এল্‌সি থাকত। আমি সেই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।

আমি প্রায় ৩২০ কিলোমিটার (২০০ মাইল) পথ সাইকেল চালিয়ে উইনিপেগে যাই, তবে সেখানে যাওয়ার সময়ে আমি কেলউড শহরে থামি, যেখানে সেই দু-জন সাক্ষি থাকতেন, যারা আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। সেখানে থাকার সময়ে আমি একটা সভায় যোগ দিই আর জানতে পারি যে, একটা মণ্ডলী বলতে কী বোঝায়। আমি এটাও বুঝতে পারি যে, প্রতিটা পুরুষ, মহিলা, যুবক ও যুবতীর ঘরে ঘরে গিয়ে শিক্ষা দেওয়া উচিত, ঠিক যেমনটা যিশু করেছিলেন।

উইনিপেগে আমার দাদা জ্যাকের সঙ্গে আমার দেখা হয়। দাদা সেই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য উত্তর অন্টারিও থেকে এসেছিল। সম্মেলনের প্রথম দিনে একজন ভাই ঘোষণা করেন যে, বাপ্তিস্মের আয়োজন করা হবে। দাদা আর আমি সেই সম্মেলনে বাপ্তিস্ম নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমরা দু-জনেই বাপ্তিস্মের পর যত দ্রুত সম্ভব, অগ্রগামী হিসেবে সেবা শুরু করার বিষয়ে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হই। দাদা সম্মেলনের পরই পূর্ণসময়ের সেবা শুরু করে। আমার বয়স তখন ১৬ বছর ছিল আর তাই, আমাকে স্কুলে ফিরে যেতে হয়েছিল। তবে, পরবর্তী বছরে আমিও একজন নিয়মিত অগ্রগামী হই।

আমি বিভিন্ন শিক্ষা লাভ করি

আমি ভাই স্ট্যান নিকালসানের সঙ্গে ম্যানিটোবা প্রদেশের সুরাস শহরে আমার অগ্রগামী সেবা শুরু করি। শীঘ্রই আমি বুঝতে পারি, অগ্রগামীর সেবা সবসময় সহজ হয় না। আমাদের কাছে থাকা টাকাপয়সা ধীরে ধীরে কমতে থাকে কিন্তু আমরা হাল ছেড়ে দিই না। একবার, সারা দিন ধরে প্রচার করার পর বাড়ি ফিরে আসার সময়ে আমাদের প্রচণ্ড খিদে পায় কিন্তু আমাদের কাছে একেবারেই টাকা ছিল না। আশ্চর্যের বিষয় হল, বাড়ি গিয়ে আমরা দেখি, দরজার সামনে একটা বড়ো বস্তায় প্রচুর খাবার রয়েছে! আজও আমরা জানি না, কে সেই বস্তাটা সেখানে রেখেছিল। সেই সন্ধ্যায় আমরা রাজার মতো খাওয়া-দাওয়া করি। আমাদের হাত শিথিল হতে না দেওয়ার জন্য কতই-না চমৎকার এক পুরস্কার! সত্যি বলতে কী, সেই মাসের শেষে আমার ওজন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে গিয়েছিল।

কয়েক মাস পর আমাদের গিলবার্ট প্লেন্‌স শহরে সেবা করার কার্যভার দেওয়া হয়, যেটা সুরাস থেকে ২৪০ কিলোমিটার (১৫০ মাইল) উত্তরে অবস্থিত। সেইসময়, প্রতিটা মণ্ডলীতে মঞ্চে একটা বড়ো তালিকা লাগানো থাকত, যেখানে প্রতি মাসে করা মণ্ডলীর ক্ষেত্রের পরিচর্যার কাজের পরিসংখ্যান দেওয়া থাকত। একবার, যখন একটা মাসে কম কাজ হয়েছিল, তখন আমি মণ্ডলীর উদ্দেশে একটা বক্তৃতা দিয়ে এই বিষয়টার উপর জোর দিই যে, ভাই-বোনদের আরও বেশি করে কাজ করতে হবে। সভার পরে একজন বয়স্ক অগ্রগামী বোন আমার কাছে আসেন, যার স্বামী সত্যে ছিলেন না। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “ভাই, আমি চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু এর চেয়ে বেশি করতে পারিনি।” এটা শুনে আমার চোখেও জল চলে আসে আর আমি তার কাছে ক্ষমা চাই।

আমার ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছিল, উদ্যমী অল্পবয়সি ভাইয়েরা খুব সহজেই এই ধরনের ভুল করে ফেলতে পারে আর তারপর, নিজেদের বিষয়ে হতাশ হতে পারে। কিন্তু আমি এটা শিখেছি যে, হাত শিথিল হতে দেওয়ার পরিবর্তে সবচেয়ে ভালো বিষয়টা হল সেই ভুল থেকে শিক্ষা লাভ করা এবং সেই শিক্ষা মনে রাখা। পরবর্তী সময়ে আপনি যে-বিশ্বস্ত কাজগুলো করবেন, সেগুলোর জন্য অবশ্যই আশীর্বাদ লাভ করবেন।

কুইবেকের লড়াই

২১ বছর বয়সে আমি এক বিশেষ সুযোগ লাভ করি! আমাকে গিলিয়েড স্কুল-এর ১৪তম ক্লাসে আমন্ত্রণ জানানো হয় আর ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি গ্র্যাজুয়েট হই। সেই ক্লাসের প্রায় চার ভাগের মধ্যে এক ভাগ ব্যক্তিকে কানাডার ফ্রেঞ্চভাষী প্রদেশ কুইবেকে পাঠানো হয়, যেখানে সাক্ষিদের প্রচণ্ড তাড়না করা হতো। আমাকে সোনার খনির এই দেশের ভ্যালডর শহরে কার্যভার দেওয়া হয়। একদিন, কয়েক জন ভাই-বোন ও আমি ভ্যাল-সেনভিল নামে পাশের একটা গ্রামে প্রচার করতে যাই। সেখানকার স্থানীয় পাদরি আমাদের হুমকি দিয়ে বলেন যে, আমরা যদি সঙ্গেসঙ্গে সেই গ্রাম ছেড়ে না যাই, তা হলে আমাদের আক্রমণ করা হবে। তার এই হুমকি আদালতে একটা মামলার দিকে পরিচালিত করে, যেখানে আমি অভিযোক্তা হিসেবে দাঁড়াই। পরিশেষে, সেই পাদরিকে জরিমানা দিতে হয়। *

এই ঘটনা ও একইরকম অন্যান্য ঘটনা “কুইবেকের লড়াই”-এর অংশ হয়ে ওঠে। কুইবেক প্রদেশটা ৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রোমান ক্যাথলিক গির্জার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল আর পাদরিরা ও তাদের রাজনৈতিক মিত্ররা যিহোবার সাক্ষিদের তাড়না করত। সেই সময়টা আমাদের জন্য সহজ ছিল না আর আমাদের সংখ্যাও কম ছিল। কিন্তু, আমরা আমাদের হাত শিথিল হতে দিইনি। কুইবেকের আন্তরিক লোকেরা ভালোভাবে সাড়া দিয়েছিল। আমি বেশ কয়েক জন ব্যক্তির সঙ্গে অধ্যয়ন করার সুযোগ পাই, যারা পরে সত্য গ্রহণ করে। আমি এমন একটা পরিবারের সঙ্গে অধ্যয়ন করি, যে-পরিবারে ১০ জন সদস্য ছিল। সেই পুরো পরিবার যিহোবার সেবা করতে শুরু করে। তাদের সাহসী উদাহরণ অন্যদের ক্যাথলিক গির্জা ছাড়তে উৎসাহিত করে। আমরা প্রচার করে চলি আর অবশেষে, সেই লড়াইয়ে জয়ী হই!

ভাইদের তাদের নিজেদের ভাষায় প্রশিক্ষণ দেওয়া

১৯৫৬ সালে, আমাকে হাইতিতে সেবা করার কার্যভার দেওয়া হয়। সেখানকার বেশিরভাগ নতুন মিশনারির ফ্রেঞ্চ ভাষা শিখতে অসুবিধা হতো কিন্তু তা সত্ত্বেও, লোকেরা তাদের কথা শুনত। স্ট্যানলি বোগাস নামে একজন মিশনারি বলেছিলেন, “আমরা এটা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে, আমরা যাতে কথার মাধ্যমে নিজেদের প্রকাশ করতে পারি, সেই বিষয়ে সাহায্য করার জন্য লোকেরা যথাসাধ্য করেছিল।” প্রথম প্রথম, আমার সমস্যা হয় না কারণ আমি কুইবেকে ফ্রেঞ্চ ভাষা শিখেছিলাম। কিন্তু শীঘ্রই, আমরা বুঝতে পারি, বেশিরভাগ স্থানীয় ভাই কেবলমাত্র হাইতিয়ান ক্রিওল ভাষাতেই কথা বলে। তাই, মিশনারিদের কার্যকারী হয়ে ওঠার জন্য স্থানীয় ভাষা শিখতেই হতো। আমরা এই ভাষা শিখি আর এই প্রচেষ্টার জন্য সত্যিই পুরস্কৃত হই।

আমরা পরিচালকগোষ্ঠীর কাছ থেকে হাইতিয়ান ক্রিওল ভাষায় প্রহরীদুর্গ পত্রিকা ও অন্যান্য প্রকাশনা অনুবাদ করার অনুমতি পাই, যাতে ভাইদের আরও বেশি করে সাহায্য করা যায়। এর ফলে, সারা দেশে সভার উপস্থিতির সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। ১৯৫০ সালে হাইতিতে মাত্র ৯৯ জন প্রকাশক ছিল কিন্তু ১৯৬০ সালের মধ্যে সেই সংখ্যা বেড়ে ৮০০-রও বেশি হয়! সেইসময়, আমাকে বেথেলে সেবা করার কার্যভার দেওয়া হয়। ১৯৬১ সালে আমি রাজ্যের পরিচর্যা বিদ্যালয় পরিচালনা করার বিষয়ে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাই। আমরা ৪০ জন মণ্ডলীর অধ্যক্ষ ও বিশেষ অগ্রগামীকে প্রশিক্ষণ দিই। ১৯৬২ সালের জানুয়ারি মাসের সম্মেলনে আমরা যোগ্য স্থানীয় ভাইদের তাদের পরিচর্যা বাড়ানোর জন্য উৎসাহিত করি এবং কয়েক জনকে বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এটা খুবই সময়োপযোগী ছিল কারণ শীঘ্রই, আমরা বিরোধিতার মুখোমুখি হই।

সেই সম্মেলনের পরই, ১৯৬২ সালের জানুয়ারি মাসের ২৩ তারিখ আ্যন্ড্রু ডামিকো নামে একজন মিশনারিকে ও আমাকে শাখা অফিসে গ্রেপ্তার করা হয় আর সজাগ হোন! পত্রিকার ১৯৬২ সালের ৮ জানুয়ারি সংখ্যার (ফ্রেঞ্চ ভাষার) পত্রিকাগুলো বাজেয়াপ্ত করা হয়। সেই পত্রিকায় ফ্রেঞ্চভাষী খবরের কাগজগুলো থেকে উদ্ধৃতি করা হয়েছিল যে, হাইতিতে লোকেরা ডাকিনীবিদ্যা নিয়ে চর্চা করে। কারো কারো এই বিবৃতিটা পছন্দ হয় না আর তারা দাবি করে যে, আমরা শাখা অফিসেই সেই প্রবন্ধটা লিখেছি। কয়েক সপ্তাহ পর, মিশনারিদের দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়। * কিন্তু, স্থানীয় ভাইয়েরা চমৎকারভাবে কাজ চালিয়ে যায়। তারা যে-ধৈর্য দেখিয়েছিল এবং তাদের বিশ্বাস যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল, তা দেখে বর্তমানে তাদের সঙ্গে সঙ্গে আমিও খুবই আনন্দিত। এখন, তাদের কাছে এমনকী হাইতিয়ান ক্রিওল ভাষায় পবিত্র শাস্ত্রের নতুন জগৎ অনুবাদ বাইবেল রয়েছে, যেটা সেই সময় আমাদের কাছে কেবল একটা স্বপ্নের মতো ছিল।

মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে নির্মাণকাজ

হাইতিতে সেবা করার পর আমাকে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে মিশনারি হিসেবে সেবা করার কার্যভার দেওয়া হয়। পরে, আমার সেখানে একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে আর পরবর্তী সময়, শাখা অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করার সুযোগ হয়।

সেই সময়, বেশিরভাগ কিংডম হল খুবই সাদামাটা ছিল। আমি জঙ্গল থেকে খড়কুটো কুড়াতে ও সেগুলো দিয়ে ছাউনি বানাতে শিখি। আমাকে এই নতুন কাজে কষ্ট করতে দেখে আশেপাশের লোকেরা বেশ অবাক হতো। এটা স্থানীয় ভাইদেরও উৎসাহিত করে যেন তারা তাদের কিংডম হলগুলো নির্মাণ করায় এবং সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করায় আরও বেশি করে অংশ নেয়। ধর্মীয় নেতারা আমাদের নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করত কারণ তাদের গির্জাগুলোতে টিনের ছাদ ছিল কিন্তু আমাদের কিংডম হলগুলোতে এমনটা ছিল না। তবে, আমরা নিরুৎসাহিত না হয়ে আমাদের সাদামাটা খড়কুটোর ছাউনি দেওয়া কিংডম হলগুলোতেই সভা করে যাই। এই ঠাট্টাতামাশা সেইসময় বন্ধ হয়ে যায়, যখন দেশের রাজধানী বাংগিতে প্রচণ্ড ঝড় হয়। ঝড়ের কারণে একটা গির্জার টিনের ছাদ উড়ে গিয়ে বড়ো রাস্তায় আছড়ে পড়ে। তবে, আমাদের কিংডম হলগুলোর খরকুটোর ছাউনিগুলো ঠিক থাকে। ঈশ্বরের রাজ্যের কাজে আরও ভালোভাবে তত্ত্বাবধান করার জন্য আমরা ঠিক পাঁচ মাসের মধ্যে একটা নতুন শাখা অফিস ও মিশনারি হোম নির্মাণ করি। *

এক উদ্যোগী সাথীর সঙ্গে বিবাহিত জীবন

আমাদের বিয়ের দিনে

১৯৭৬ সালে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে ঈশ্বরের রাজ্যের কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় এবং আমাকে পার্শ্ববর্তী একটা দেশ চাদের রাজধানী এন্‌জামিনাতে সেবা করার কার্যভার দেওয়া হয়। আনন্দের বিষয় হল, হ্যাপি নামে একজন উদ্যোগী বিশেষ অগ্রগামী বোনের সঙ্গে আমার দেখা হয়, যার জন্ম হয়েছে ক্যামেরুনে। আমরা ১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাসের ১ তারিখে বিয়ে করি। সেই মাসেই গৃহযুদ্ধ শুরু হয় আর অনেকের মতো আমরাও সেই দেশের দক্ষিণে পালিয়ে যাই। যখন যুদ্ধ শেষ হয়, তখন আমরা ফিরে এসে দেখি যে, আমাদের বাড়ি একটা সশস্ত্র দলের মুখ্য কার্যালয়ে পরিণত হয়েছিল। শুধু আমাদের সাহিত্যাদিই নয় কিন্তু সেইসঙ্গে হ্যাপির বিয়ের পোশাক এবং আমাদের বিয়ের সমস্ত উপহার আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু, আমরা আমাদের হাত শিথিল হতে দিইনি। আনন্দের বিষয় এই যে, আমরা একসঙ্গে ছিলাম আর আমরা ভবিষ্যতে আরও কাজ করার আশা রেখেছিলাম।

প্রায় দু-বছর পর, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের উপর থেকে সেই নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়া হয়। আমরা সেখানে ফিরে গিয়ে সেখানে ভ্রমণের কাজ করি। আমরা একটা গাড়ির মধ্যেই থাকতাম, যেটার মধ্যে একটা ফোল্ডিং বেড, ২০০ লিটার (৫৩ গ্যালন) জল রাখার মতো একটা পাত্র, প্রোপেন গ্যাসের রেফ্রিজারেটর আর একটা গ্যাসের বার্নার ছিল। ভ্রমণ করা বেশ কঠিন ছিল। একবার, এক জায়গায় যাওয়ার সময়ে আমাদের ১১৭ বার পুলিশের চেকপয়েন্টে থামানো হয়েছিল।

সেখানকার তাপমাত্রা প্রায়ই বেড়ে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (১২২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) পৌঁছাতো। কখনো কখনো, সম্মেলনগুলোতে বাপ্তিস্মের জন্য পর্যাপ্ত জল পাওয়া কঠিন হতো। তাই, ভাইয়েরা শুষ্ক নদী গর্ভে মাটি খুঁড়ে একটু একটু করে বাপ্তিস্মের জন্য পর্যাপ্ত জল জমা করত আর প্রায়ই একটা বড়ো পাত্রের মধ্যে বাপ্তিস্ম দেওয়া হতো।

আমরা আফ্রিকার অন্যান্য দেশে আরও কাজ করি

১৯৮০ সালে, আমাদের নাইজেরিয়াতে যেতে বলা হয়। সেখানে আড়াই বছর ধরে আমরা নতুন শাখা অফিসের নির্মাণকাজের প্রস্তুতিতে সাহায্য করি। ভাইয়েরা একটা দোতলা গুদামঘর কিনেছিল, যেটাকে অংশ অংশ করে খুলে আমাদের সেই জায়গায় স্থাপন করার পরিকল্পনা করা হয়। একদিন সকালে, আমি ওই খোলার কাজে সাহায্য করার জন্য সেই বিল্ডিংটার বেশ উঁচুতে চড়ি। দুপুরের দিকে, আমি যেভাবে উপরে চড়েছিলাম, সেভাবেই নীচের দিকে নামতে শুরু করি। কিন্তু, আমি বুঝতে পারিনি যে, বিভিন্ন অংশকে খোলার কারণে অনেক কিছু পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল আর আমি ফাঁকা জায়গায় পা দেওয়ার ফলে সেই বিল্ডিং থেকে পড়ে যাই। আমার অবস্থা বেশ আশঙ্কাজনক বলে মনে হয়েছিল কিন্তু কয়েকটা এক্স-রে ও পরীক্ষানিরীক্ষা করার পর ডাক্তার হ্যাপিকে বলেছিলেন: “চিন্তা করবেন না। বেশি কিছু হয়নি, কয়েকটা লিগামেন্টে আঘাত লেগেছে। উনি দু-এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবেন।”

‘গণপরিবহণে’ একটা সম্মেলনে যাওয়ার পথে

১৯৮৬ সালে আমরা কোট ডিভোরে চলে যাই আর সেখানে ভ্রমণের কাজ করি। সেই কাজ করতে করতে আমরা পার্শ্ববর্তী বুরকিনা ফাসো দেশ পর্যন্ত যাই। সেইসময় আমি কল্পনাও করতে পারিনি যে, অনেক বছর পর আমরা কিছু সময়ের জন্য বুরকিনাতেই বাস করব।

ভ্রমণের কাজ করার সময়ে আমরা একটা গাড়ির মধ্যে থাকতাম

আমি ১৯৫৬ সালে কানাডা ছেড়ে গিয়েছিলাম কিন্তু ৪৭ বছর পর ২০০৩ সালে, আমি আবারও কানাডায় ফিরে গিয়ে বেথেলে সেবা করি আর এবার, আমার সঙ্গে হ্যাপিও ছিল। কাগজে-কলমে আমরা কানাডার নাগরিক ছিলাম ঠিকই কিন্তু মন থেকে আমরা নিজেদের আফ্রিকার লোক বলেই মনে করতাম।

বুরকিনা ফাসোতে একটা বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করছি

এরপর ২০০৭ সালে, আমার বয়স যখন ৭৯ বছর, তখন আমরা আবার আফ্রিকায় সেবা করার সুযোগ পাই! আমাদের বুরকিনা ফাসোতে সেবা করার কার্যভার দেওয়া হয়, যেখানে আমি কান্ট্রি কমিটি-র একজন সদস্য হিসেবে সাহায্য করি। পরবর্তী সময়ে, সেই অফিসটাকে বেনিন শাখা অফিসের অধীনে একটা শাখা থেকে দূরবর্তী অনুবাদ অফিসে পরিণত করা হয় আর ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে আমাদের বেনিনের বেথেলে সেবা করার কার্যভার দেওয়া হয়।

বেনিনের শাখা অফিসে সেবা করার সময়ে হ্যাপির সঙ্গে

আমার শারীরিক সীমাবদ্ধতাগুলো সত্ত্বেও, পরিচর্যার কাজ এখনও আমার কাছে খুবই প্রিয়। বিগত তিন বছরে, প্রাচীনদের সদয় সাহায্য ও আমার স্ত্রীর প্রেমময় সমর্থনের ফলে আমি আমার দু-জন বাইবেল ছাত্রকে বাপ্তিস্ম নিতে দেখার আনন্দ লাভ করেছি। তাদের নাম হল জেডেয়োঁ ও ফ্রেজিস আর তারা এখন উদ্যোগের সঙ্গে যিহোবার সেবা করেন।

আমার স্ত্রী ও আমাকে দক্ষিণ আফ্রিকার শাখা অফিসে পাঠানো হয়, যেখানকার বেথেল পরিবার সদয়ভাবে আমার স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়। আমি আফ্রিকায় যে-সমস্ত দেশে সেবা করার বিশেষ সুযোগ পেয়েছি, সেগুলোর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা হল সপ্তম দেশ। এরপর, ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে আমরা একটা অপূর্ব আশীর্বাদ লাভ করি। আমরা নিউ ইয়র্কের ওয়ারউইকে বিশ্বপ্রধান কার্যালয়ের উৎসর্গীকরণে যোগ দেওয়ার সুযোগ পাই। আমরা কোনো দিনও সেই উৎসর্গীকরণটা ভুলতে পারব না!

বর্ষপুস্তক ১৯৯৪ বইয়ের ২৫৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে: “যারা অনেক বছর ধরে ধৈর্যের সঙ্গে এই কাজ করে গিয়েছে, তাদের আমরা এই জোরালো পরামর্শ দিই: ‘তোমরা বলবান হও, তোমাদের হস্ত শিথিল না হউক, কেননা তোমাদের কার্য্য পুরস্কৃত হইবে।’—২ বংশা. ১৫:৭.” হ্যাপি ও আমি এই জোরালো পরামর্শ মেনে চলার এবং অন্যদেরও একই বিষয় করতে উৎসাহিত করার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ।

^ অনু. 9 ১৯৪৪ সালে যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত। এখন আর ছাপানো হয় না।

^ অনু. 18 ১৯৫৩ সালের ৮ নভেম্বর সজাগ হোন! (ইংরেজি) পত্রিকার ৩-৫ পৃষ্ঠায় দেওয়া “যিহোবার সাক্ষিদের আক্রমণ করার দায়ে কুইবেকের পাদরিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়” শিরোনামের প্রবন্ধটা দেখুন।

^ অনু. 23 বিস্তারিত তথ্য যিহোবার সাক্ষিদের বর্ষপুস্তক ১৯৯৪ (ইংরেজি) বইয়ের ১৪৮-১৫০ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করা হয়েছে।

^ অনু. 26 ১৯৬৬ সালের ৮ মে সজাগ হোন! (ইংরেজি) পত্রিকার ২৭ পৃষ্ঠায় দেওয়া “এক দৃঢ় ভিত্তির উপর নির্মাণ করা” শিরোনামের প্রবন্ধটা দেখুন।